ফাস্টফুড
"চট করে গোবিন্দ'র দোকানে যা তো। পিসিদের প্রত্যেকের জন্যে দুটো করে সিঙ্গারা আর একটা করে নিমকি নিবি। বাড়ির লোকের জন্যে একটা করে। আর দু রকমের সন্দেশ নিবি, দুটাকা পিস আর এক টাকা পিস, দুটোই একটা একটা করে, শুধু পিসিদের জন্যে। বুঝলি?"
হ্যাঁ বলে ঘাড় নেড়ে বেরোতে যাবো, আবার পিছন থেকে ডাক।
"আর শোন, যদি দেখিস সিঙ্গারা শেষ হয়ে গেছে, তাহলে নিমকি নেওয়ার দরকার নেই। ওখান থেকে শুধু মিষ্টি নিয়ে ফটিকের দোকানে চলে যাবি। আলুর চপ টা ওদের জন্যে দুটো করে আর পেয়াজি বা ফুলুরি, যেটা পাবি, সবার জন্যে একটা করে। মনে থাকবে? আর ওদের মুখের গোড়া দিয়ে যাস না। খিড়কির দোর দিয়ে যা!"
আটের দশক অবধি শহরতলী বা মফস্বল এলাকার বাঙালির "ফাস্টফুড"এর বৈচিত্র বলতে এটাই ছিল মোটামুটি। বাড়িতে আত্মীয়স্বজন আসার আগে ফোন করার ব্যবস্থাই ছিল না। ফলে সন্ধ্যেবেলা বাড়িতে কেউ এলে চটজলদি (fast) কিছু খাবারের (food) ব্যবস্থা কেই তখন ফাস্টফুড বলে জানতাম। কারণ, বেরোনোর সময় লাস্টে কানে আসতো, "পা গুনে গুনে হাটিস না আবার, দৌড়ে যাবি, ছুটে আসবি।"
ধীরে ধীরে নগরায়নের বহর বৃদ্ধি হতে শুরু করায় ওই আটের দশকের মাঝামাঝি থেকে চিত্রটা বদলাতে শুরু করলো যেন। কচুরি ও আলুর তরকারি / ডাল, ওই পুজোর বাজার করতে শ্যামবাজার - হাতিবাগান গেলে বা কালীঘাট / দক্ষিণেশ্বরে পুজো দিতে গেলে তবেই জুটতো কপালে, ইয়ে মানে উদরে। ওটাও কিন্তু একপ্রকার ফাস্টফুড, বাঙালির কাছে, সকালের জলখাবার। খাস কলকাতার বুকে হরিদাস মোদক হোক বা পুটিরাম কিংবা শ্রীহরি, কচুরি ও আলুর তরকারির চলন থাকলেও আমাদের বাড়িতে তার প্রবেশে কড়াকড়ি ছিল কিছুটা। কারণ, এগুলো মূলত বাজারের মধ্যের দোকানে পাওয়া যেত এবং বাজারের দোকানদার ও কর্মচারীরা ছিলেন টার্গেট কাস্টমার। তাই একদিকে একটা উন্নসিক ভাব ও অন্যদিকে অর্থনৈতিক হিসেবে ইনি ব্রাত্য থাকতেন। বড়জোর, মাসে একটা রবিবার সকালে, সেটাও ওই রামায়ণ মহাভারত টিভিতে দেখানো চালু হওয়ার পর, দেরিতে ঘুম ভাঙলে জলখাবার করতে গিয়ে যদি মিস হয়ে যায়, তাই পারমিশন গ্র্যান্টেড।
ইতি উতি একটা দুটো ফিশফ্রাই কাটলেট মোঘলাই এর দোকান থাকলেও এনারাও বৈঠকখানার বাইরেই থাকতেন। ওই ন মাসে ছয় মাসে একবার, ঘুরতে গেলে, ট্যাক্সি তে উঠে মিটারের দিকে না তাকিয়ে ধর্মতলা ভিক্টোরিয়া শ্যামবাজার বা গড়িয়াহাট গেলে, তবেই। মফস্বল যখন শহরতলী তে রুপান্তরিত হচ্ছিল, এনাদের ভায়রাভাই, ভেজিটেবল চপ (এবং অন্যান্য চপ) তখন ধীর লয়ে জায়গা করে নিতে শুরু করেছে পাড়ার মোড়ের আলুর চপ ফুলুরির দোকানে। নিজামের নবাবিয়ানা ছেড়ে ইতি উতি একটা দুটো রোলের দোকান ও খুলেছে। অফিস থেকে ফেরার পথে কোনো কোনোদিন, চপের ঠোঙা বা রোল হাতে বাবা বাড়ি ঢুকলে মন টা আনন্দে ভরে যেত। কারণ সারাদিনের অপকর্মের ফিরিস্তি টা মা বাবার কানে দিলেও, বকার সাথে মুখরোচক কিছু জিনিস ও আছে যে!
আসলে তখন অবধি (আটের দশকের মাঝামাঝি) বিকেলবেলার জলযোগ বলতে আমাদের কাছে মুড়ি চানাচুর চিরেভাজা ডালমুট নিমকি নাড়ু, এসবেরই চল ছিল। কিছু না হলে থিন আরারুট বিস্কুট। সকালে রুটি, পরোটা, পাউরুটি, দই চিড়ে বা বিশেষ দিনে লুচি তরকারি। কচিৎ কদাচিৎ চিড়ের পোলাও, ঝাল সুজি, ঘুগনি, আলুরদম। বাইরের খাবার খাওয়া বলতে সচরাচর ফুচকা, আলুকাবলি বা গান বাজিয়ে ভ্যান গাড়িতে করে বিক্রি করতে আসা হরেক রকমের আচার।
এই সময় হঠাৎ একটি জিনিসের প্রবেশ ঘটল আমাদের বাড়িতে। ম্যাগী।। ইনস্ট্যান্ট নুডুলস। দু মিনিটেই তৈরি। ফাস্টেস্ট ফুড। কিন্তু গোল বাঁধলো অন্য জায়গায়। প্যাকেটের গায়ে ভালো করে খেয়াল করা না হলেও, ভিতর থেকে যে মশলার পাউচ টি বের হলেন, তার গায়ে লেখা, চিকেন মশালা। টানাপোড়েন শুরু, কারণ বাড়িতে তখনও রাম পাখির মাংসের এন্ট্রি, স্ট্রিকটলি প্রহিবিটেড। সে বারের মত দুই ভাই মিলে সেটা খেয়ে উদ্ধার করলেও পরের বার থেকে খুঁজে খুঁজে ভেজ মশালা টাই আনা হত। এনার পিছু পিছু আরো দুজন প্রবেশ করলেন, ম্যাগী হট অ্যান্ড সুইট সস আর চাউ চাউ (একটা ব্র্যান্ড, পরে জেনেছি আসলে খাবারটির নাম চাউমিন)। কিন্তু কোথায় সোয়া সস বা চিলি সস? সাদা তেলে হলুদ ধনে জিরে দিয়ে বানানো হত, উপরে ওই হট অ্যান্ড সুইট সস, যেটা কিনা অ্যাকসিডেন্টালি ম্যাগীর সাথে ফ্রি তে প্রথম এসেছিল বাড়িতে।
শহরতলী থেকে শহর এর যাত্রাপথ টা কিন্তু অতি দ্রুত ছিল। নয়ের দশকের শুরুর সময় একটা বিরাট চেঞ্জ এলো। উদার অর্থনীতি ও গ্লোবালাইজেশনের হাত ধরে আমাদের মত বাঙালি রা ও উইকেন্ডে শপিং সেরে খেয়েদেয়ে বাড়ি ফেরার পথে পা বাড়ালো। আগেকার সেই মাসকাবারি কনসেপ্ট বা নববর্ষ ও পুজো বাদে সুন্দর জামাকাপড় না কেনার অলিখিত নিয়ম গুলো ধীরে ধীরে শিথিল হতে লাগল। উদার অর্থনীতি র হাওয়া পালে লাগতে, ছোট বড় রেস্টুরেন্ট ও খাবারের দোকানের সংখ্যাও বৃদ্ধি পেতে লাগলো। রোল চাউমিন এর সাথে একই গুমটী তে স্থান পেলো মোঘলাই চিলি চিকেন। পাড়ার চপের দোকানের কাচের শোকেসে চপের পাশাপাশি জায়গা করে নিল ফিশ ফ্রাই, কাটলেট। সন্ধ্যেবেলা বাড়ি ফিরে মুড়ি চানাচুর খাওয়ার জায়গায়, বাইরে থেকে মুখরোচক কিছু খেয়ে বা কিনে বাড়ি নিয়ে গিয়ে খাওয়া টা রপ্ত করে ফেললাম।
এরপর রাজ্য ছাড়িয়ে ভিনরাজ্যের খাবারের ছোটোখাটো স্টল ও খুলতে লাগলো রাস্তার আশেপাশে (বাঙালির চাউমিন বা চিলি চিকেন, নিখাদ বাঙালি, তাকে আর যাই হোক, চৈনিক বলা যায় না, অন্তত তখনও)। ধোসা ইডলি, মোমো, লিটটি চোখা, পাও ভাজি, বড়া পাও, ধোকলা, দহি বড়া, কি নেই সেই লিস্টে। যুগ পরিবর্তনের সাথে সাথে বাঙালির চিড়ের পোলাও এর জায়গা দখল করল পোহা, ঝাল সুজি হয়ে গেল উপমা।
তবু একটা জিনিস তখনও ফাস্টফুড এর লিস্টের বাইরে ছিল। বিরিয়ানি। জানি বিরিয়ানি কখনই ফাস্টফুড নয়, কিন্তু অর্থনীতির জোয়ারে গা ভাসিয়ে, আমরা তাকেও ফাস্টফুডের লিস্টে ঢুকিয়ে ফেললাম নয়ের দশকের শেষ দিকে। আজ যে বাঙালি বিরিয়ানি বলতে অজ্ঞান, মনে করে দেখবেন, বছর পঁচিশ আগেও এই ক্রেজ টা ছিল না। নবাবি খানা তখনও মহার্ঘ ছিল, নামজাদা রেস্টুরেন্টের মেনু কার্ডেই থাকতো। বাঙালির বিরিয়ানি প্রেমের (অনু)ঘটক কিন্তু ওই ছোট ছোট স্টল গুলো। রাস্তার পাশে বা ছোট রেস্টুরেন্টে হাফ প্লেট, এক্সট্রা মটন বা আলু দেওয়ার রেওয়াজ চালু হতেই বিরিয়ানি জাত খুইয়ে পাতে এসে উঠলো সাধারণ বাঙালির।
এখন তো যে কোনো সময় যা কিছু খাওয়া যায়, বাইরে বেরোলেই আমাদের কাছে অজস্র অপশন। শেরওয়ানি থেকে বিরিয়ানি, ঝুমকা থেকে থুকপা, সবই এখন রেডিলি এভলেবেল। বলার সাথে সাথেই হাতে, সুপার ফাস্ট।
গ্লোবালাইজেশন তৈরি করল এমন চওড়া রাস্তা, যে আমাদের জলখাবার হয়ে গেল নাস্তা। আমার মত বাঙালির খাদ্যাভ্যাসে এ যেন এক হুলুস্থুলু অবস্থা, কারণ ফাস্টফুডের নামে এখন বিক্রি হয় পান্তা থেকে পাস্তা।
বেশ লিখেছেন। মিলিয়ে নিতে পারছি।
ReplyDelete