পুজো ও বামুন



লক্ষ্মীপুজো সরস্বতী পুজো আসলেই পৈতে ধারী বামুনের চাহিদা তুঙ্গে উঠে যায়। সবার বাড়িতে পুজো আর তাই পুরুতকে নিয়ে টানাটানি চলে ভীষণ। এমনি দিনে যে সব বামুন পুজো আচ্চার ধার ধারে না, জীবনে আহ্নিক করেছে কিনা সন্দেহ, তাদেরকেও দেখতাম এই দু দিন ধুতি পড়ে, নামাবলী জড়িয়ে মায় গলায় রুদ্রাক্ষের মালা ঝুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

আমার পৈতে হয় ক্লাস সেভেনে। আমাদের বাড়ির কেউ কোনোদিন বাড়ির বাইরে পুজো করেনি, মানে যজমানী করেনি। বাবা, দাদা বা আমি, কেউই তার ব্যতিক্রম হই নি। আমাদের বাড়িতেও আগে পুরোহিত এসেই লক্ষ্মী সরস্বতী পুজোর দিন পুজো করত। চেনা পুরোহিত, দূরসম্পর্কের আত্মীয়। কিন্তু কখনো রাত দশটায় বা বিকেল চারটে তে লক্ষ্মী পুজো অথবা ভোর পাঁচটায় সরস্বতী পুজো করতে আসাটা রেওয়াজ হয়ে দাঁড়ানোয়, বিরক্তির পরিমাণ বাড়তে লাগলো। বিশেষত দেরী হলে কোন বাড়িতে আছে, এবং খুঁজে আনা, বিরাট ঝক্কির কাজ ছিল। উল্টোদিকে পুরোহিতের বিরক্তিও বাড়তে থাকে, কারণ, না ভুলভাল মন্ত্র পড়ে পুজো করতে পারে, না শর্টকাটে সারতে পারেন।

শেষ অবধি বাবা ঠিক করলেন, বাড়ির পুজো নিজেই করবেন। আমার ও দাদার পৈতের আগের বছরই প্রথমবার বাবা নিজে বাড়ির লক্ষ্মী ও সরস্বতী পুজো করলেন। কিন্তু নিজে বই দেখে দেখে পুজো করা অনেক ঝক্কির ব্যাপার। আমাদের পৈতের পর ঠিক হল লক্ষ্মী পুজো দাদা ও সরস্বতী পুজো আমি করবো। করবো মানে, বাবা বই দেখে পরপর মন্ত্র ও পুজোপদ্ধতি বলে যাবে, আমরা সেটা ফলো করে যাবো।

শুরু হল বামুনের যাত্রা। (প্রথম কয়েক বছর এই ভাবে চললেও, তারপর দাদা চাকরিসূত্রে বাইরে চলে যেতে, দুটো পুজোই আমি করতাম।) পুজোর কয়েকদিন আগে থেকে বাবা বেশ কিছু মন্ত্র, (বারংবার ব্যবহৃত হবে এমন) ও হস্ত মুদ্রা রপ্ত করাতেন আমাদের। তারপরেও, সেই বছর অষ্টমীতে অঞ্জলী দিতে দিতে যেমন আড়চোখে তাকানোর অনুশীলন করেছিলাম, পুজোর সময় হস্ত মুদ্রা ভুলে একই কায়দায় বই থেকে সেটা দেখতে হত। নিজেরা বাড়ির পুজো করতে বসে, আমরা বুঝতে পারলাম, যে একটা পুজো সম্পূর্ণ রূপে করতে কমপক্ষে দেড় ঘণ্টা সময় লাগে।

এইবার সবাই ভাববে, তাহলে বাড়িতে পুরুত এসে কুড়ি মিনিটে কি করে পুজো করে যায়? আপনার ও আপনার পরিবারের মঙ্গলকামনায় পুজোর সংকল্প, মূল দেবতার পুজো, নৈবেদ্য, রচনা, ফলমূলাদী, তাম্বুল ও অন্ন (যদি অন্ন ভোগ থাকে) নিবেদন ও আপনাদের পুষ্পাঞ্জলি দেওয়ানো। কুড়ি মিনিট গড়পড়তা এইটুকুই সম্ভব।

কিন্তু কেন বলতে পারেন? আপনার বা আপনার পরিবারের মঙ্গল কামনা আপনার থেকে ভালো কে করতে পারে বলুন তো? আমি বলছি, কেউ না। কিন্তু ব্রাহ্মণ দিয়েই পুজো করাতে হবে বলে, রাস্তার মোড়ের থেকে ধুতি নামাবলী পরিহিত যাকে খুশি আপনি আমিই ধরে আনি। আর একদিনের জন্যে পুরুত হওয়া কিছু কিছু লোক সেই ফায়দাটাই তোলে, আপনার আমার অন্ধ বিশ্বাসের।

কিন্তু কিছু প্রতিষ্ঠিত পূরোহিতও (যারা সারা বছর যজমানী করেন) এটা করে থাকে। কেন জানেন? এটা শুনতে ভালো লাগবে না হয়তো, তাও লিখছি। পুজো আচ্চা কিন্তু সেই মানুষটার পেশা। তাই দিয়েই তার সংসার চলে, তার বাড়ির বাচ্চারা যজমানীর দক্ষিণা তেই পড়াশোনা করে। যে মানুষটা সারাদিন উপোস করে আমার আপনার মঙ্গল কামনায় পুজো করতে আসে, তার সাথে আমরা কি ব্যবহার করি?
বাড়িতে বিশাল আড়ম্বরে পুজো হবে, চার পাঁচ রকমের মিষ্টি। বাড়িতে অনেক লোকজন খাবে, তাই ঠাকুর দিয়ে রান্না হয় অনেক বাড়িতে। এদিকে যে বিশ্বাসে বামুন দিয়ে পূজা করানো, সেই বিশ্বাস অনুযায়ী নৈবেদ্য র আতপ চালটা যেহেতু পুরুতের প্রাপ্য, তাই সেটার পরিমাণ অল্প। তার গুণগত মান নিয়ে নাই বা বললাম। সেটাও যদি সে পুজো শেষে নিতে যায়, তাহলে ছাঁদা  বাঁধা পুরুত বলে লোকে কথা শোনাবে। আর বেশ কিছু বাড়ির পুজো থাকলে সে যদি ছেড়ে যায়, তাহলে অল্পসংখ্যক যজমানই বাড়ি বয়ে তা দিয়ে আসবে। ঠিক যেমন ঘটের গামছা, মায়ের শাড়ি বা নারায়ণের ধুতি টাও দিয়ে আসতে অনেকের কষ্ট হয়। অবশ্য না দিলেও চলে, কারণ দশকর্মার দোকান থেকে কেনা গামছার টুকরো গুলো দিয়ে আপনার সদ্যজাত শিশুর পাছাও ঢাকবেনা, পুরুতের তো দুরঅস্ত। ধুতিও তথৈবচ। ছাপার শাড়ি খানা মোটামুটি ঘরে পরার মত, কারণ বামুনের বউএর তো বাইরে বেরোনোর ব্যাপার নেই, তাই। দক্ষিণা র কথা ছেড়েই দিলাম, কারোর নিজের হাফদিনের স্যালারিও কেউ দিই?

মানছি, কিছু লোভী লোক থাকেই। কালীপুজোর বা সেইদিন যে লক্ষ্মী পুজো হয়, তখন ভাইফোঁটার দিন শালা কে ফ্রায়েড রাইস খাওয়ানোর বাসমতি চাল লেখায়, ওই পুজোর ফর্দে। নিজে দেখেছি।

কিন্তু তাও বলছি, এক হাতে তালি বাজে না। তাই, নিজের ও পরিবারের মঙ্গল কামনায় যে পুজো, সেটা নিজেরা করলেই বোধহয় ভালো হয়। না পুরুত খুঁজে সময়ে নিয়ে আসার ঝক্কি, না সে ঠিকঠাক পুজো করলো কিনা তাই নিয়ে অস্বস্তি। উল্টো দিকে কিছু ভন্ডদের কারবার বন্ধ হবে আর বাকি বামুন গুলো কে ফালতু পিঠ পিছে গাল শুনতে হবে না। কি বলেন?

সুব্রত চৌধুরী

Comments

Popular posts from this blog

কার্তিক পুজো ও খাওয়াদাওয়া

তালশাঁস সন্দেশ