কার্তিক পুজো ও খাওয়াদাওয়া



এবার বাড়ি গিয়ে পুরানো কাগজ ঘাটতে ঘাটতে একটা কাগজ পেলাম। তিনি অবশ্য এতই দীর্ণ জীর্ণ ছিলেন যে তাকে খুলতে গিয়ে অক্ষত রাখা যায়নি। তবে যে টুকু উদ্ধার করলাম (বাকিটা আন্দাজ), তা এইরকম ছিল হয়তো:
কার্তিক ঠাকুর হ্যাংলা
আমরা তার চ্যালা
পেটভরে খাবো মোরা
ঘরে হবে পোলা।

(ধ্রুব সত্যি হল, সেই সময় পোলা না লিখে মেয়ের কথা লিখলে, খাওয়া তো দূর, মূর্তির দাম ও কেউ দিত না হয়তো। আমি মোটেও কন্যাসন্তান বিদ্বেষী নই, এবং সন্তান হিসেবে রাজকুমারী কে পেয়ে আমি ঈশ্বরের কাছে কৃতজ্ঞ।)
মূর্তির দাম - ১৫১/-
খাওয়া দাওয়া
সাদা ভাত
মুগ ডাল
ঝুরো আলুভাজা
ফুলকপির রসা
কাতলা কালিয়া
খাসির মাংস
জলপাইয়ের চাটনি
রসগোল্লা
মিষ্টি দই

ইতি - সবার নাম লেখা থাকত।

কোনো এক বছর কারোর বাড়িতে কার্তিক ফেলার জন্যে ঠাকুরের হাতে দেওয়া লিস্ট ছিল। কার্তিক মাসের সংক্রান্তির আগের রাত্রে নব বিবাহিত ও নিঃসন্তান দম্পতির উঠোনে কার্তিক ঠাকুর ফেলা, এক বহু পুরানো রেওয়াজ। (মজার ছলে ব্যাপারটা চললেও, কিছু কিছু জায়গায় যে তা উৎপাত বা উপদ্রবের পর্যায় পৌঁছে যায়, সেটা অস্বীকার করা যায় না।)

আমাদের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল কার্তিক পুজোর নামে পেট পুজো। দিন দুয়েক আগে থেকে প্ল্যানিং চালু হত। প্রথমে ক্লায়েন্ট সিলেকশন। পোটেনশিয়াল ক্লায়েন্ট কে কে আছে তার লিস্ট রেডি করা। তারপর রেইকি বা সার্ভে, মানে বাড়ির কোন জায়গায় মূর্তি রাখা হবে, দরজায় - উঠোনে - বারান্দায়। ফ্ল্যাট বাড়ি তে কার্তিক ফেলা এক দূরহ ব্যাপার, বারান্দার উচ্চতা থেকে গ্রিলের গ্যাপ, সব হিসাব রাখতে হবে। এরপর বাজেট, কারণ একাধিক বাড়িতে মূর্তি ফেলতে হলে ক্যাপিটাল ইনভেস্টমেন্ট চাই। তাই কে কত ধার দিতে পারবে, তার লিস্ট রেডি করে সাথে কন্টিনযেন্সি ফান্ডের ব্যবস্থা। এবং প্ল্যানিং এর সর্বশেষ ধাপ, রিটার্ন অফ ইনভেস্টমেন্ট, মানে মূর্তির দাম ফেরত এবং ভুরিভোজ। ভুরিভোজের মেনু বানানো টা একটা আর্ট। কটা বাড়িতে কার্তিক ফেলা হবে ও তার সাথে সামঞ্জস্য রেখে (অবশ্যই গৃহকর্তার অবস্থা মাথায় রেখে) সিরিয়ালি কোন কোন বাড়িতে কখন ও কি কি খাওয়া হবে, এমন পার্মুটেশন কম্বিনেশন করা যে কি ঝক্কির, সে যে করেছে সেই জানে।

এরপর এক্সিকিউশন। এক বা একাধিক সুন্দর ছোটখাটো মূর্তি সন্ধ্যেবেলা কিনে এনে কোথাও লুকিয়ে রাখতে হবে। প্রত্যেকটা মূর্তির সাথে রেসপেক্টিভ মেনু লিস্ট (মূর্তির দাম সহ) ভালোভাবে ঝোলাতে হবে। টার্গেট করে রাখা বাড়িতে রাত দেড়টা নাগাদ অভিযান চালু হত। ফ্ল্যাট বাড়ি হলে কেবল এর মই বেয়ে উপরে ওঠা ও গ্রিলের ফাঁক দিয়ে গলিয়ে মূর্তিটি কে বিনা আওয়াজে ও অক্ষত অবস্থায় বারান্দায় নামানো হল আরো একটি শিল্পকলা। সুষ্ঠ ভাবে সব মিটিয়ে বাড়ি ফিরে সিধা ঘুম। পরদিন সকালে প্রত্যেক বাড়িতে একবার করে মুখ দেখিয়ে এবং মেনুটা মনে করিয়ে দিয়ে আসা অবশ্যকর্তব্য। তার জন্যে পকেটে ডুপ্লিকেট মেনু রাখতে হত, যাতে গুলিয়ে না যায়।

সারাদিনের প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে সন্ধ্যে থেকে শুরু হত, খ্যাটন উৎসব। এমনও গেছে, সন্ধ্যেবেলা যাবো বলে কোনো বাড়িতে মটন রোল, রুমালি রুটি ও কষা মাংস লিখে কার্তিক ঠাকুরের হাতে ঝুলিয়ে এসেছি। অন্য কিছু লিখিনি, যাতে পেটে জায়গা থাকে। এবার তাদের বাড়ি উপস্থিত হতেই সর্বাগ্রে আমার দিকেই প্রশ্নবাণ ধেয়ে আসত, "তুই বামুন, এবার এই রোল - রুমালি - কষা, ঠাকুরকে তুই নিবেদন করবি। আর কিছু লিখিস নি বলে আমরাও কিছু বানাইনি।" বোঝো ঠ্যালা।

এই সব আকাম করতে গিয়ে বকা খেয়েছি, ঝগড়া হয়েছে আবার আদর ভালোবাসাও পেয়েছি। আর পেয়েছি কিছু চমক, কার্তিক ফেলতে গিয়ে লটকানো নোটিশ / হুমকি / অনুরোধ। কেমন?

একজন লিখে রেখেছিল "কার্তিক ফেলে লাভ নেই, সে বাবা মা যতই তোদের বলুক। আমাদের নিজস্ব প্ল্যান আছে।"

তবে সবচাইতে মারাত্মক নোটিশ ছিল এরকম
"Work in progress. ঠাকুর ফেললেও পয়সা পাবি না। লেখাটা পড়ে জানালায় উকি ঝুঁকি দিতে এলে বাটাম পেটা করব।"

©সুব্রত চৌধুরী

Comments

Popular posts from this blog

পুজো ও বামুন

তালশাঁস সন্দেশ