গনাদার জামাইষষ্ঠী
লকডাউনের বাজারে যাদের "ডাকাবুকো জামাই" আখ্যা দিয়ে "এলিজিবল ফর জামাই ষষ্ঠীর খ্যাটন" বলে চিহ্নিত করা হচ্ছে, এ হচ্ছে তেমনই এক জামাইয়ের কাহিনী। আমাদের গনাদা।
গনাদা পাড়ার মধ্যেই প্রেম করেছিল। ক্লাবের ঠিক পাশের বাড়িতে ভাড়া এসেছিল বৌদি, থুড়ি, তখন মাম্পি দি। ক্লাবে ক্যারম খেলার সময় গনাদা ঠিক জানলার উল্টো দিকে দাড়াতো। সেই জানলা দিয়েই সামনের বারান্দায় দাড়ানো মাম্পী দির সাথে "আঁখো হি আঁখো মে ইশারা হো গ্যয়া"। কিন্তু মুশকিল টা হল, চিরাচরিত কেস, হিরোইনের বাবা ভিলেন। না, মানে ঠিক ভিলেন না, তবে রাম লখন সিনেমার মাধুরীর বাবা অনুপম খের টাইপ। জেঠু ব্যাংক ম্যানেজার হলে কি হবে, হেব্বি কিপ্পু, দুর্গাপুজোয় পাড়ার সবাই যখন গড়পড়তা একশ টাকা চাঁদা দেয়, উনি প্রথমবার এসে ১০ টাকা ঠেকালেন। গনাদা একা থাকলে হয়ত ওটা নিয়েই চলে আসত, কিন্তু বাকিরা নাছোড়বান্দা। অনেক বলে কয়ে বুঝিয়ে বাঝিয়েও শেষমেষ ১৮ টাকার বেশি সেটা ওঠেনি। যুক্তিগুলো যদিও অসাধারণ ছিল। বাড়িওয়ালা ১০০ টাকা চাঁদা দিলে ভাড়াটে হিসেবে ওনার হাফ হওয়া উচিত। তাহলে অন্তত পঞ্চাশ টাকা দিন। উহু, সবে তিন মাস এসেছি, বছরের এক চতুর্থাংশ কাটিয়েছি, তাই সাড়ে বারো টাকা হয়, তার থেকেও ক্লাবের হই হল্লা সহ্য করতে হয় বলে আড়াই টাকা কেটে, ১০ টাকা বরাদ্দ। যতই ওনাকে বলা হয়, সাড়ে চার মাস হল আপনি এসেছেন, উনি মানতে রাজি নন, কারণ তখন ট্রান্সফারের পর বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকতে শুরু করলেও, পরিবার এনেছি তিন মাস। অনেক কষ্টে হিসেব করে দেখা গেল, চার মাস বারো দিন উনি এসেছেন, মানে বছরের ৩৬%, তাই পঞ্চাশ টাকার ৩৬% হিসেবে ১৮ টাকা বরাদ্দ করলেন।
গনাদার কাছে বিশাল চাপের ব্যাপার ছিল, এহেন হবু শ্বশুর কে রাজি করানো। গনাদা তাই ভাবলেন, শ্বশুরের আগে শ্বাশুড়ী কে পটাতে হবে। যখনই হবু শ্বাশুড়ী কে বারান্দায় দেখতে পেত, ক্লাবের থেকে বেরিয়ে "জাহ্নবী যমুনা বিগলিত করুণা" হয়ে জিজ্ঞেস করত, কাকিমা বাজার যাচ্ছিলাম, কিছু এনে দিতে হবে। প্রথম প্রথম একটু সংকোচ করলেও আস্তে আস্তে কিছু দরকার পড়লে উনি গনাদা কেই বলতেন। গনাদাও তিন লাফে বাজার থেকে সেই জিনিস নিয়ে আসত। হবু "মাদার-ইন-ল" টাকা দিতে এলেই "মাতা-ঋণ-লও" এর মত একটা হাবভাব করে যুদ্ধ জয়ের হাসি নিয়ে সিধা ক্লাবে। ব্যাপারটা ধীরে ধীরে কাকুর গোচরে আসল। উনিও সুযোগ বুঝে নিজে বাজার করার পরিমাণ কমিয়ে দিলেন। কিছুদিন পর থেকে ব্যাপারটা রুটিন হয়ে গেল। আমরা আড়ালে গনাদাকে মাম্পিদি দের বাজার সরকার বলতাম।
বছর দেড়েক বাদে শেষমেষ জেঠু রাজি হলেন, বিয়ে ঠিক হল। বৈশাখ মাসের শেষ দিকে বিয়ে। তখনও ক্লাবঘর বিয়েবাড়ির জন্যে ভাড়া দেওয়া শুরু হয় নি। কিন্তু জেঠু বিয়েবাড়ি ভাড়া নেবেন না বলে, ক্লাবের অফিস ঘরে বিয়ে আর টেবিল টেনিস খেলার বড় ঘরে খাওয়া দাওয়া। গরমের দিনে যাতে নিমন্ত্রিতদের পেট গরম না হয়, জেঠু সেদিকেও খেয়াল রেখে ছিলেন। প্রথমে তো আমিষ কিছু করবেন নাই ভেবেছিলেন, মেয়ে বউএর চাপে পড়ে শেষ অবধি পোলাও মাংস বাদ দিয়ে সাদা ভাতের সাথে কাতলা মাছের প্লেন ঝোল হয়েছিলো। নিন্দুকেরা বলে, রান্নার ঠাকুরের টাকাও গুনতে হছিল গনাদা কেই।
যাই হোক, সব ঠিকঠাক মিটে যাওয়ার এক মাস বাদেই এল জামাই ষষ্ঠী। গনাদা ও মাম্পিদি, থুড়ি তখন বৌদি, ঝাক্কাস মাঞ্জা দিয়ে জেঠু ও জেঠিমার জন্যে কেনা জামাকাপড় হাতে ক্লাবের সামনের মিষ্টির দোকানে ঢুকল। দু তিন রকমের মিষ্টি ও এক হাঁড়ি রসগোল্লা নিয়ে দোলাতে দোলাতে আমাদের দিকে মুচকি হেসে কলিং বেল বাজালো। তারপরেই এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। দরজা খুলতেই মেয়ে পাশ দিয়ে ভিতরে ঢুকে গেল আর জেঠু গনাদার দিকে তাকিয়ে রইলেন। গনাদা খানিকটা থমকে দাড়িয়ে আছে আর আমরাও হা করে তাকিয়ে আছি।
সবাইকে অবাক করে দিয়ে জেঠু বললেন, শুধু মিষ্টি আনলে? বাজার করে আনোনি? গনাদা ভেবলে যেতেই বললেন, না, আমার তো অফিস আছে, দেরী হয়ে যাচ্ছে। আর তুমি তো ভালোই বাজার করো, তাই বললাম। তবে গরমের দিন, গুরুপাক কিছু এনোনা কিন্তু। বলেই উনি ধা। আমাদের হাসতে দেখে গনাদা রেগে গিয়ে সামনের সব্জিওয়ালার থেকে হাফ কিলো পটল কিনেই গজগজ করতে করতে শ্বশুরবাড়ি ঢুকে পড়ল।
বিকেল বেলা ক্যারম খেলতে খেলতে শুনলাম, রাস্তায় বেরিয়ে গনাদা বৌদিকে বলছে, কাকিমার বানানো চাল পটলের দিব্যি, তোমার বাবা পটল না তোলা অবধি আমি আর জামাই ষষ্ঠী করতে আসছি না।।
Comments
Post a Comment