অনিমন্ত্রিত



"এই ভাই! আপনার নাম কি? কোথায় বাড়ি?" - বিয়েবাড়িতে খেতে বসে, এমন প্রশ্ন শুনে লোকজনকে ঢোক গিলতে দেখেছেন?
এখনকার বিয়েবাড়ি গুলোতে খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারটা অধিকাংশ জায়গায় বুফে হয়ে যাওয়ায় একটা শিল্পকলা লুপ্তপ্রায় পর্যায়ে চলে গেছে। অপরিচিত কোনো বিয়েবাড়িতে ঢুকে খেয়ে আসার শিল্পকলা। মানছি, বিনা নিমন্ত্রণে বুফে তে ঢুকেও লোকজন খেয়েই আসে, হয়তো আগের থেকে বেশিই, থ্রি ইডিয়েটস সিনেমার মত। কিন্তু বিয়েবাড়ির ভিড়ে ভালো ড্রেস পড়ে বুফের কাউন্টার থেকে প্লেট নিয়ে যে টুকু ইচ্ছা খেয়েই চলে আসা যায়। বা খেতে খেতে কেউ সন্দেহের চোখে দেখলে, প্রশ্ন করার সুযোগ না দিয়ে, ঘুরে অন্য দিকের ভিড়ে মিশে গিয়ে প্লেট রেখে বেরিয়ে আসার মধ্যে সেই থ্রিল টা নেই মশাই।
থ্রিল তো তখন ছিল, যখন মাঠের মধ্যে বিয়েবাড়ির প্যান্ডেলে ঢুকে লম্বা টেবিলের ব্যাচে একসাথে বসে খেতে হত। হায়ার করা ক্যাটারারের সার্ভিং বয় না, পরিবেশন করতো পরিবারের সদস্য বা পাড়ার ছেলেরা, খাওয়ার মধ্যে একবার হলেও গৃহকর্তা এসে কথা বলে আপ্যায়ন করে যেত। এদের মধ্যে কেউ সন্দেহের চোখে দেখছে, বুঝতে পারলেও, স্বাভাবিক হয়ে পুরো ব্যাচের সাথে একসাথে খাওয়া শেষ করে পাত ত্যাগ করতে হবে। আর ওই প্রথম প্রশ্ন শুনলে ঢোক গিলে থতমত খেয়েও কিছু একটা উত্তর দিয়ে এবং ধরা না পড়ে, বাড়ি ফেরা। কারণ ধরা পড়লে সেখানে কপালে যা জুটতো, তা জুটতো, সেটা বাড়িতে জানলে তার এফেক্ট টা খুবই ভয়াবহ হতে পারতো।
আপনারা তো সবাই ভালো মানুষ, এমন কাজ নিশ্চয়ই করেননি। আমিও ভালো মানুষ ছিলাম জানেন, তবে ওই বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে বা ফিশ ফ্রাইয়ের গন্ধে মাঝেমধ্যে একটু পা ফসকে যেত বইকি!! কিছু পাবলিক তো আবার বাজি ধরেও এই কীর্তি করতে যেত।
তখনকার, সেই মাঠের মধ্যে প্যান্ডেল বেঁধে বিয়ে / বৌভাতের অনুষ্ঠানে, বিনা নিমন্ত্রণে খেতে যাওয়ার বেশ কিছু নিয়মাবলী ছিল। একটা খাম (টাকা থাকুক কি ফাঁকা) ধরিয়ে দেওয়া টা রীতি হয়ে ওঠেনি তখনও। একধরনের গোলাপী সাদা ফুল ফুল কাগজ ছিল গিফট মোড়ার জন্যে। কিছু না পেলে সাদা খাতা ওই কাগজে মুড়ে হাতে নিয়ে ঢুকতে হত বিয়েবাড়িতে। ওটাই ছিল গেটপাস। ওটা শেষমেশ, কনের হাতে দেওয়া হল, কি হল না, সেটা ম্যাটার করতো না যদিও।
বিয়েবাড়িতে ঢোকার টাইমিং টা এবং কোন ব্যাচে বসতে হবে, সেই হিসেবটা যদিও পারফেক্টলি কষতে হত। বরযাত্রী বা কনেযাত্রী যে ব্যাচে বসবে, সেই ব্যাচে কদাচিৎ বসতে নেই, বসতে হত তার পরের ব্যাচে। আগের ব্যাচে বেয়াই বাড়ির লোকেদের আপ্যায়ন করে হাঁপিয়ে উঠে, লোকজন একটু কম আসবে পরের ব্যাচের তদারকিতে। তারপরের হিসেব হল, কোথায় বসতে হবে। মোটামুটি প্যান্ডেলের শেষ মাথার দিকের কোনার টেবিলের লাস্ট সিট, একেবারে পারফেক্ট চয়েস। যদি দু চারজন বন্ধুবান্ধব মিলে যাওয়া হয়, তাহলে পাশাপাশি দুজনের বেশি বসা চলবে না। আবার অন্যদের থেকে বেশি দূরে বা এদিক ওদিক হলেও চলবে না। সামনের লম্বা টেবিলে মুখোমুখি বসতে হবে। যাতে সন্দেহ দৃষ্টি পড়লে হঠাৎ করে যেন পরিচিত কাউকে খুঁজে পেয়ে কথোপকথন চালিয়ে পরিস্থিতি হালকা করা যায়।
এবারে মূল অধ্যায়, খাওয়া। প্রথমে লুচি ছোলার ডাল বা রাধাবল্লভি, এগুলো টেস্ট ম্যাচের প্রথম দিনের প্রথম সেশনের মত। খাবো কী খাবো না, ভাবতে ভাবতে এক কি বড়োজোর দুপিস, এনাফ। ভেজিটেবল চপ হলে একটা, ফিশ ফ্রাই হলে দু তিনটে, তার বেশি না। ভাতের সাথে মাছের কালিয়া, খাসির মাংস যাই আসুক, নব্বইয়ের ঘরে ব্যাটিং করতে থাকা সচিন। যতই অফস্টাম্প এর বাইরে বল আসুক, ব্যাট চালানোর, ইয়ে মানে যতই যেচে পরিবেশন করুক, ভুলেও নিজের ক্যালিবার দেখানো যাবে না। লোকজনের দৃষ্টি কিন্তু তাহলে নিজের দিকে ঘুরে যেতে পারে। সচিনের যেমন সেঞ্চুরিটা পাখির চোখ ছিল, এনাদেরও কিন্তু খেয়েদেয়ে না ধরা পড়ে, বাইরে বেরিয়ে আসা টাই লক্ষ্য।
চাটনি পাঁপড় রসগোল্লা, এগুলোও ওই খুচরো সিঙ্গেলস। একান্তই যদি স্লগ ওভারের ধোনি হতে চাইতো কেউ, তাহলে ঐ সন্দেশ ও দই। বিয়েবাড়ির লোকজন তখন ব্যস্ত, পরের ব্যাচে কারা কারা বসবে, তাদের ডাকতে, কেউ দেখার নেই।
এবারে মেন ব্যাপার, এক্সিট প্ল্যান। যদি কেউ সন্দেহের চোখে একবারও না তাকিয়ে থাকে, তাহলে রাস্তা স্মুথ। যদি অল্পবিস্তর সন্দেহের দৃষ্টি ঘোরাফেরা করে থাকে, তাহলে খাওয়া শেষে খাবার ও পরিবেশনের প্রশংসা করতে করতে এগিয়ে যেতে হত। যদি দু তিনজনের র‍্যাডারে এসে গিয়ে থাকে কেউ, তাহলে এবার রিস্ক আছে। সেক্ষেত্রে ওই প্রথমোক্ত প্রশ্ন আসতে বাধ্য, খাওয়া দাওয়ার সময়ই আসবে।  যদি বর কনের ঠিকুজির কিছুটা জানা থাকে, তাহলে ওভারস্মার্ট হওয়ার চেষ্টা করত কেউ কেউ। না হলে, এই পরিস্থিতিতে একমাত্র উপায়, নিজেকে ইলেকট্রিশিয়ান বা জেনারেটর অপারেটর বানিয়ে দেওয়া।
উত্তরে লোকজন যদি সন্তুষ্ট না হয়, তাহলে কিন্তু একটাই সলিউশন বাকি থাকে। যে জন্যে, বসার জায়গা টা প্যান্ডেলের কোনায় নিতে হয়। সবাই খাওয়া শেষে উঠে দাড়ালে, বসে পড়তে হবে, আর প্যান্ডেলের কাপড় একটু তুলে .............!!!!

Comments

Popular posts from this blog

কার্তিক পুজো ও খাওয়াদাওয়া

তালশাঁস সন্দেশ

পুজো ও বামুন