পূজোর চাঁদা



চাঁদনী থেকে হাটতে হাটতে হিন্দ সিনেমার কাছাকাছি আসতেই হঠাৎ করে থমকে দাড়ায় সঞ্জয়। ঠিক দেখছে?? কিন্তু এত চড়া মেকআপ, এমন উগ্র সাজ-পোশাক, এটা কি রীনা দি?? সেই, পাড়ার রীনা দি?

কিন্তু, সে তো আজ বছর চার পাঁচেক আগের কথা। সঞ্জয় সে বছর মাধ্যমিক দেবে, ফাল্গুন মাসে রীনার বিয়ে হয়। ছেলের মুদিখানার দোকান, বড় ভাইয়ের সাথে একসাথে অবশ্য। কিন্তু বিয়ের পাঁচ মাসের মধ্যেই স্বামী মারা যায়, আর রীনাও মাসখানেক বাদেই বাপের বাড়িতে ফিরে আসে। কিন্তু, ওই, অভাগা যেদিকে চায়, সাগর শুকিয়ে যায়। বাড়ি ফিরে বাপের কাছে ঠাই মিললেও ফিরে আসার বছরখানেকের মধ্যেই একটা বাস দুর্ঘটনায় বাবা মাও মারা গেল। নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের অল্পশিক্ষিতা বিধবা মেয়েটা দাদার সংসারেই ছিল, বিনা পয়সার কাজের লোক, দু বেলা দুমুঠো খাবার। যদিও পাড়া প্রতিবেশীদের মধ্যে অনেকেই রাক্ষসী, ডাইনি বলত পিঠ পিছে, কিন্তু তাও চুপচাপ মুখ বুজে দাদার সংসারেই পরে থাকতো রীনা।

হঠাৎ করেই তার পরের বছর পূজোর সময় থেকে আর রীনা কে কেউ দেখতে পায় না। তার কদিন আগেই দাদা বৌদির সাথে ঘুরতে গেছিল দীঘায়, কিন্তু ফিরে আসার কদিনের মধ্যেই, নবমীর রাতে কোথায় যেন হারিয়ে গেল। দশমীর দিন ভাসানের সময় দীপক, রীনার দাদা, সবাইকে জানিয়েছিল রীনা নাকি কাকে ভালোবাসতো, তার সাথেই পালিয়ে গেছে। অল্প বয়সী, সুন্দরী, হোক না বিধবা - তাতে তো আরো সুবিধা, এমন একটি মেয়ে, পাড়ার পুরুষ গুলো কে পাত্তা না দিয়ে অন্য কারোর সাথে পালিয়ে গেল, এটা ভেবেই না জানে কত বিবাহিত পুরুষের দীর্ঘশ্বাস পড়েছিল সেদিন। এবং তার পরদিন থেকে নানা রকমের মুখরোচক গল্প ছড়াতে বেশি সময় লাগে নি।

বছর দেড়েক আগে রঞ্জিৎদা অবশ্য একদিন ক্যারম খেলতে খেলতে বলেছিল একটা কথা, "রীনা খারাপ লাইনে চলে গেছে মনে হয়।" সরল, সাধা সিধা সঞ্জয়ের অবশ্য বিশ্বাস হয় নি কথাটা। মা বাপের একমাত্র সন্তান, তাই ছোটবেলায় রীনা কেই দিদি বলে ডাকতো। সহজ সরল ছেলেটার মুখে বাকিদের মত খিস্তি খাস্তা ছিল না। মাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিক পেরিয়ে গেলেও পাড়ার বাকি ছেলেদের মত নেশা করত না, মেয়ে দেখলে টোন কাটে না।  রীনাদিও সঞ্জয় কে নিজের ভাইয়ের মতই স্নেহ করতো। সেদিন রঞ্জিৎদার কথাটা মানতে মন চায় নি। কিন্তু আজ??

দূর থেকে ভালো করে তাকিয়ে দেখে নিশ্চিত হতে চায় সঞ্জয়। একটা লোকের সাথে কথা বলতে বলতে মহিলাটি হেসে উঠতেই সঞ্জয় বুঝতে পারে, ভুল সে করেনি, পরন্ত বিকেলের আলোয়ও ঠিকই। আর রঞ্জিৎদার কথাটাও তাহলে মিথ্যা ছিল না। কিন্তু কেন? কেন এমন করল রীনাদি? প্রশ্নটা মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতেই হন হন করে হাটতে শুরু করে সঞ্জয়। ওরকম ভাবে সঞ্জয়কে এগিয়ে আসতে দেখে মহিলাটি রাস্তা পেরিয়ে বউবাজারের দিকে তাড়াতাড়ি হাঁটা লাগায়। এতক্ষণ যে লোকটার সাথে কথা বলছিল, সে বেচারা হতবাক হয়ে দাড়িয়ে থাকে। সঞ্জয় ও গতি বাড়ায়, সে শিওর, ওটা ওর রীনাদিই। গলা তুলে "রীনাদি, ও রীনাদি?" বলে ডাকতেই মহিলাটি পাশ দিয়ে ধীর গতির চলন্ত ট্রামের ফার্স্ট ক্লাস কম্পার্টমেন্টে লাফিয়ে উঠে পড়ল। সঞ্জয় ও নাছোড়বান্দা, দৌড়তে শুরু করল। ট্রাম টাও কিছুটা গতি নিয়েছে, তাই অনেক কষ্টে দৌড়ে এসে পিছনের কামরায় উঠলো সঞ্জয়। ভিতরে ঢুকলো না যদিও, দরজার কাছেই দাড়িয়ে রইল। বউবাজার সিগন্যালে ট্রাম দাড়াতেই, সামনের কামরার দিকে এগোতে যাবে, মহিলাটি ট্রাম থেকে নেমে সোজা হাঁটা। সঞ্জয়ও হাঁটা লাগালো, কোনো মতে দুজনেই চলন্ত গাড়ির রাস্তা পেরিয়ে গেল। একটু এগিয়ে গিয়ে, প্রায় ছানা পট্টির সামনে, হঠাৎ সঞ্জয় নিজের ডান হাতটা বাড়িয়ে মহিলার বা হাতটা ধরে আটকালো, "রীনাদি, দাড়াও। আমি তোমায় চিনতে পেরেছি।"

মহিলার ডান হাতটা সপাটে আছরে পড়ল সঞ্জয়ের বা গালে। এক ঝটকায় নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে চেঁচিয়ে উঠল "কে বে? হারামী শালা, কে রীনা? আমার নাম সোনালী। ভুল ভাল একটা নাম ধরে ডেকে মেয়েছেলের গায়ে হাত দেওয়ার খুব শখ না?"

ভরা রাস্তার মধ্যে একটা ছেলেকে একজন মহিলা এমন কথা বললেই, স্বাভাবিক ভাবেই ভিড় জমতে সময় লাগে না। সাথে দু চার ঘা ফাউ। "এই এলাকায় এসব বাঁদরামি, মার শালাকে"। দু চার ঘা পরার পর সবার খেয়াল হয়, যে মহিলার হাত ধরেছিল, সেই সিনে নেই। কেউ কেউ "ছাড় বে, পয়সা নিয়ে ঝামেলা বোধহয়। মালটাকে দেখলি না, হাড়কাঁটা গলির মাল হবে, ফালতু ঝামেলা করে লাভ নেই।" আসতে আসতে ভিড় পাতলা হয়ে যায়।

নাকের কাছটা একটু ব্যাথা করে সঞ্জয়ের। হাত দিয়ে দেখে অল্প রক্ত, হাতটা ভাজ করে জামার হাতায় মুছে নিয়ে আশপাশে তাকিয়ে দেখে একবার। নাহ্, রীনাদি কোথাও নেই, ঠিক সরে পড়েছে। যে সঞ্জয়কে, নিজের ভাইয়ের মতই স্নেহ করত, তাকেই আজ মার খাওয়ালো রীনাদি!!! রঞ্জিৎদার কথাটাই ঠিক তবে।


ওয়েলিংটনের কাছে একটা পার্টির কাছে পুজোর স্যুভেনিরের যে লাস্ট কনট্র্যাক্ট ফর্মটা দেওয়ার কথা ছিল, সেটা বেশ কিছুটা ছিড়ে গেছে, ধস্তাধস্তিতে। পাড়ার পুজোতে সঞ্জয়কে এবার সহ সম্পাদক করে দিয়েছে সবাই মিলে, সাথে স্যুভেনিরের দায়িত্ব টাও ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছে। মধ্যমগ্রাম থেকে কলকাতা এসে এই ফর্ম গছানো ও আবার পরে এসে টাকা কালেক্ট করাটা বড় ঝক্কির। মাতৃ হারা, বাপের হোটেলে থাকা হাবা গোবা ছেলেটাই উপযুক্ত, ঘরের খেয়ে বোনের মোষ তাড়ানোর কাজে।

এই ছেড়া ফাটা কনট্র্যাক্ট ফর্ম নিয়ে অ্যাড চাইতে যাওয়া ঠিক হবে না, তাই দেরি না করে শিয়ালদহ স্টেশনের দিকে পা বাড়ায় সঞ্জয়। বউবাজার অবধি তো এসেই গেছে, সোজা হেঁটে ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া পেরোলেই তো আরেকটু। বাবার পেনশন ও জমানো টাকার সুদে মোটামুটি চলে যায় বাপ ব্যাটার। অভাব না থাকলেও, খুব একটা তো স্বচ্ছলতা নেই, তাই ট্রেনে গেলে দু টাকা তো বাঁচবে, এক বান্ডিল বিড়ি হয়ে যাবে। হাঁটতে হাঁটতে পকেটে হাত দিয়ে বিড়ির প্যাকেটটা পেলেও দেশলাই টা খুঁজে পায় না, মনে হয় পাবলিকের ধাক্কাধাক্কি তে পকেট থেকে পড়ে গেছে।

সেনকো'র দোকানের পরের গলিটা পার করেই বিহারীর পান বিড়ির দোকানের গায়ে জ্বলন্ত নারকেল দড়ি টা দেখতে পেল সঞ্জয়। পকেট থেকে একটা বিড়ি বার করে জ্বালাতেই, পিছন থেকে শুনতে পেল, "এই সঞ্জয়"!!! গলির দিকে ফিরতেই দেখে, রীনাদি দাড়িয়ে, ডাকছে। থতমত খেয়ে কোনমতে বিড়িটা ফেলে এগোতেই শুনলো "চুপচাপ আমার পিছন পিছন হাঁটতে থাক, একটু তফাত রেখে হাঁটবি, কোনো কথা বলবি না, আমার সাথেও না বা কেউ ডাকলেও না।"
গলিটার শেষ মাথায় গিয়ে ডানদিকে বেঁকে বাদিকে ঘুরতেই সঞ্জয় দেখে রাস্তার দু পাশে বেশ কিছু অল্পবয়সি মেয়ে ও মধ্যবয়সি মহিলা দাড়িয়ে। সবারই মুখে সস্তার মেকআপ, রীনাদির মতই, তবে পোশাক যেন আরো খোলামেলা। বুঝতে পারে, পতিতাপল্লীতে এসে পড়েছে। কি করবে, ভাবতে একটু থমকাতেই খেয়াল হয়, রীনাদি অনেকটা এগিয়ে গেছে, এদিকে দু একটা মেয়ে তার দিকে কুৎসিত ইশারা করছে তো কেউ খিস্তি দিচ্ছে। কোনো দিকে না তাকিয়ে স্পিড বাড়িয়ে রীনাদি কেই ফলো করতে থাকে সঞ্জয়। বেশ কিছু অলিগলি পেরিয়ে শেষ মেশ একটা খুপরি ঘরের মধ্যে ঢুকে যায় রীনা, পিছন ফিরে দেখে নেয় সঞ্জয় কে।
সঞ্জয় ঘরে এসে ঢুকতেই দরজার খিল দিয়ে খাটে উঠে বসে রীনা। 

"খুব উন্নতি হয়েছে দেখছি? বিড়ি ফুঁকতে শুরু করেছিস, কলকাতায় এসে মেয়েছেলে দেখছিস!! তা, বাকি বন্ধুদের মত গ্যাজা ও চুল্লু খাওয়াও শুরু করেছিস নাকি?"

"না, মানে ওই সিগারেট বিড়িই খাই।"

"সাথে এখন মেয়েছেলের ও শখ হয়েছে তাহলে!!" বলেই হাসতে থাকে রীনা।

"আমি তোমাকে চিনতে পেরেই তবে ডেকেছিলাম। কিন্তু তুমি যে এইভাবে মার খাওয়াবে, সেটা ভাবিনি।"

"কেন? আমার সাথে তোর কিসের দরকার শুনি? সুরসুর করছে? লাগাতে ইচ্ছা করছিল?"

রীনা দির কথা শুনে কান্না চলে আসে সঞ্জয়ের চোখে। ছলছল চোখে তাকিয়ে থাকে।
"ন্যাকামো করতে হবে না, আমায় ডাকছিলি কেন বল। ওসব আলগা পিরীত আমার আর সহ্য হয় না রে। তাড়াতাড়ি বল, ধান্দার টাইম।"

"দীপকদা পাড়ায় সবাইকে বলেছিল, তুমি নাকি কাকে ভালোবাসতে, তার সাথে পালিয়ে গেছো। কত লোকে কত কি বলতো। তারপর একদিন রঞ্জিৎদা বলেছিল, তুমি নাকি খারাপ লাইনে চলে গেছো। আমার মন মানতে চায়নি রীনা দি। তাই তোমায় দেখতে পেয়েই ডেকেছিলাম।"

"ডাকার কি ছিল? দেখেই তো বুঝতে পেরেছিলি, যে রঞ্জিৎ এর কথাটা ঠিক। রঞ্জিৎ ও ওর বোনের বিয়ের গয়না কিনতে এসে আমায় রাস্তায় দেখেছিল। ও ঘাটায় নি, আমি ও সরে গেছিলাম। তোর হঠাৎ কি হল?"

"কেন এলে রীনা দি এই নরকে? আমি শুধু এইটুকুই জানতে চাইছিলাম।"

"এটা নরক হলে, এর আগে আমি কোথায় ছিলাম?"
"মানে?"

"বিয়ার খাবি? সাথে চিকেন পকোড়া? দাড়া, বলে আসছি।"
"আমি বিয়ার খাই না। তোমাকে কিছুই আনাতে হবে না। তুমি আমার কথার উত্তর টা দাও শুধু।"

"নে, তাহলে একটা সিগারেট খা" বলে নিজে একটা ধরিয়ে সঞ্জয়ের দিকে সিগারেট ও দেশলাইয়ের প্যাকেটটা এগিয়ে দেয় রীনা। এক মুখ ধোয়া ছেড়ে সঞ্জয়ের দিকে তাকিয়ে বলে "কতক্ষন দাড়িয়ে থাকবি? খাটে এসে বস। ভয় নেই, তোকে আমি রেপ করবো না, টাকাও চাইবো না।"

সঞ্জয় খাটে এসে বসলেও সিগারেট ধরায় না। হাজার হোক, রীনাদি কে নিজের দিদির মতই শ্রদ্ধা করত।
"কি রে, খুব আশ্চর্য্য লাগছে না? আমি সিগারেট খাচ্ছি, বিয়ার খাওয়ার কথা বলছি, বেশ্যা মাগী হয়ে গেছি, তাই না? তোরা কি ভাবতিস আমার স্বামী মারা যাওয়ার পর আমি খুব ভালো পরিবেশে ছিলাম? পাড়ায় কাউকে বলিনি, নিজের মা বাপ যখন পুরোপুরি বিশ্বাস করেনি, অন্যরাও করবে না জানতাম। তুইও বিশ্বাস করবি কিনা জানি না, তাও বলছি। যেদিন নিমাই মারা গেল, অশৌচ কাটার আগে থেকেই কানাইদা, আমার ভাসুর, ফন্দি আঁটতে শুরু করলো, কি করে ব্যবসাটা একা বাগাবে। অশৌচ মিটলে পরে একদিন দুপুরে আমার কাছে এলো। প্রথমে কুপ্রস্তাব দিল, তারপরে ধর্ষণ করতে গেল। আমি লাথি মারতে উল্টে নিজেই আগে চিৎকার করতে শুরু করল। বড় জা, শাশুড়ি ছুটে আসতে তাদের বলল, আমি নাকি তাকে ডেকে এনেছিলাম দেহের জ্বালা মেটাতে। বিয়ের কদিনের মধ্যেই স্বামী মারা গেছে, তাই শাশুড়ি বলল, এক ছেলেকে গিলে শান্তি হয় নি, আরেক ছেলেকে নাকি খেতে চাই। জা ভাবলো, আমি তার সংসার ভাঙতে চাই। কেউ আমার কথা শুনলো না। বেশ্যা, মাগী, বাজারের মেয়েছেলে, এসব কথা শুনিয়ে রাস্তায় বার করে দিল তারা। এসে জুটলাম বাপের বাড়িতে। বাপ মা দাদা বৌদি কেউ মানে না আমার কথা, উল্টে চুপ করে থাকতে বলল, পাছে দুর্নাম না হয়। মা বাবা ছিল বলে একটা ঘর জুটল, না হলে দাদা বৌদিও লাথ মেরেই তাড়িয়ে দিত সেইদিনই। তবে বৌদির খোটা হজম করেই থাকতে হত। উল্টোডাঙার একটা নার্সিংহোমে আয়ার কাজ পেলাম, সেটাও ছাড়তে হল। বিনে পয়সার চাকর যদি হাতছাড়া হয়ে যায়, বৌদি আমার নামে কুকথা রটিয়ে বন্ধ করালো।"
আরেকটা সিগারেট ধরায় রীনা। "তারপর বাবা মা একসাথে মারা যেতে ওদের সুবিধা হয়ে গেল। তোদের কি বলেছিল দাদা, সবার সাথে আমাকে নিয়েও কোথায় ঘুরতে গেছিলো?"

"দীপক দা তো সবাইকে বলেছিল দীঘা।"

"আমাকেও যাওয়ার আগে তাই বলেছিল। কিন্তু নিয়ে গেছিল রায়চক, নিজের বসের বাগানবাড়িতে। আমায় দিয়ে নিজের প্রমোশনের রাস্তা পাকা করেছিল। দু দিন ধরে জানোয়ারটা আমায় ছিড়ে খুড়ে খেলো, আর আমার দাদা বৌদি দাড়িয়ে দাড়িয়ে দেখলো।"

"ফিরে এসে তুমি পুলিশে রিপোর্ট করলে না কেন?"

"তোদের দীপক দার বসের পুলিশ মহলে অনেক চেনাশোনা। তাছাড়া দু দিন অত্যাচ্যার করে চলে গেলেও আমাকে ছেড়েছিল চার দিন বাদে। মেডিক্যাল চেকআপ করিয়েও প্রমাণ করতে অনেক অসুবিধা হত। তাই তো নবমীর দিন সবাই ঠাকুর দেখতে যেতেই সুযোগ বুঝে বাড়ি থেকে পালিয়ে এলাম।"

"তাই বলে এইখানে?"

"বাড়ি থেকে পালিয়ে প্রথমে গেছিলাম সেই আয়ার কাজেই। একটা বাড়িতে পাঠালো, সেখানেও মালিকের চোখে একই লালসা। শালা সবাই শরীর চায়। খুবলে খাবে আর তারপর দু মুঠো খাবার বা কটা টাকা ছুড়ে দেবে ভিক্ষার মত। ওই আয়া সেন্টারেই আলাপ হয় ললিতার সাথে। ওর চেনা শোনা ছিল এদিকে, চলে আসি।" একটু দম নিয়ে বলে ওঠে "এখন আমি ঠিক করি আমি কাকে শরীর বেচব, কতক্ষনের জন্য বেচব, কত টাকায় বেচব।"

"কিন্তু এই ভাবে কতদিন, রীনা দি?"

"যতদিন ততদিন" একটা কাষ্ঠ হাসি ফুটে ওঠে রীনার মুখে, বিদ্রুপের না দুঃখের, বুঝতে পারে না সঞ্জয়। "ছাড় দেখিনি। তুই এইদিকে কি করতে এসেছিলি, সেটা বল?"

"এবার পুজোয় আমি এসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি। স্যুভেনির এর দায়িত্ব আমায় দিয়েছে। আগের দু তিন বছরের যারা অ্যাড দিয়েছিল, প্রত্যেক পার্টির কাছেই কনট্র্যাক্ট ফর্ম দিয়ে যাচ্ছি। কলকাতার অফিস পাড়ার দিকটা আমার দায়িত্ব। হাজার পচিশেক টার্গেট আমার। সেই ফর্ম দিতেই এসেছিলাম।" বলে পকেট থেকে অল্প ছেড়া ফর্মটা বার করে দেখায় সঞ্জয়। "পাবলিকের মারের চোটে এটাও ছিড়ে গেল, তাই আর ওয়েলিংটনের পার্টি টাকে দেওয়া হল না।"

"বালের স্যুভেনির শালা। পাতার পর পাতা শুধু অ্যাড। সামনে দু কলম লেখা। মাঝে দুটো চোতা মারা বস্তাপঁচা গল্প আর চারটে ফালতু কবিতা, এই তো থাকে। আমার বাবা বেঁচে থাকতে কম অ্যাড তো এনে দিত না পুজোয়!! পুজোর পর বাড়িতে একবান্ডিল ওই বই দিয়ে যেত, সেগুলো আবার পার্টিকে পৌঁছাও। শালা, লোকে অ্যাড জোগাড় করে এনে দেবে আর কমিটির লোকজন সেই টাকা দিয়ে নম নম করে পুজো সেরে বাকি টাকায় ফুর্তি করবে।"

"না রীনা দি!! এখন আমরা রয়েছি। দু বছর হল, ক্লাবে দাতব্য চিকিৎসালয় খুলেছি। সপ্তাহে একদিন। পুজো ফান্ডের টাকা বাঁচিয়ে চালানো হয়। তুমি এসো একদিন এবার, দেখতে পাবে।"

সঞ্জয়ের কথায় হো হো করে হেসে ওঠে রীনা। "আমাকে ওখানে আর কে ঢুকতে দেবে এখন? উল্টে কিছু কে দেখবি সামনে খিস্তি করছে আর পিছনে আমার ডেরার খোঁজ করছে। তুই আয় সঞ্জয়, সন্ধ্যে হয়ে গেছে। আমাদের এটাই সময়।"

সঞ্জয় ধীর পায়ে উঠে দরজার দিকে এগিয়ে যায়।
"দাড়া, এটা রাখ!" ৫০০ টাকার দুটো নোট এগিয়ে দেয় রীনা।
"এটা কিসের জন্যে?"
"যে কনট্র্যাক্ট ফর্ম টা ছিড়ে গেছে ওটা রেখে যা।"
"আমি পাড়ায় গিয়ে কি বলব? তুমি দিয়েছ?"
"স্যুভেনিরে ওয়েল উইশার লিখে ছেপে দিস। আমি দিয়েছি বললে কেউ নেবে না, উল্টে তোকে নানা কথা শোনাবে, তোর নামেও নোংরা ইঙ্গিত করবে।"
দরজা খুলে সঞ্জয় কে রওনা করাতে গিয়ে ওর ইতস্তত ভাব দেখে রীনা বলে ওঠে "ইট বালি সিমেন্টের চক্করে তো আর এখন উঠোন নেই, তাই মাটিও নেই। অথচ আমাদের উঠোনের মাটিই নাকি মা দুর্গার মূর্তি তৈরি তে প্রথম লাগে, কাঠামের খড়ের উপর। এই টাকাটা না হয় সেই উঠোনের মাটিই ভাবিস সঞ্জয়।"

বন্ধ হয়ে যাওয়া দরজাটার দিকে একপলক তাকিয়ে থাকে সঞ্জয়, ধীর পায়ে রাস্তার দিকে এগিয়ে চলে যায়।

© সুব্রত চৌধুরী

Comments

Popular posts from this blog

কার্তিক পুজো ও খাওয়াদাওয়া

তালশাঁস সন্দেশ

পুজো ও বামুন