গন্ধরাজ চিকেন
এবার কলকাতা থেকে ফেরার সময় ভাগ্যিস ট্রেনে ফিরেছিলাম, প্লেনে উঠতে গেলে নির্ঘাত একস্ট্রা আর্থিক ভোগান্তি ছিল কপালে। ট্রেনেও যে একেবারে নিশ্চিন্ত ছিলাম তা নয়, যখন তখন প্যাসেঞ্জার কম্পার্টমেন্টে বানিজ্যিক মাল নিয়ে যাওয়ার কেসে ফেঁসে যেতে পারতাম। কি ছিল না? পোস্তর প্যাকেট, জিরে গুঁড়া, সবজি মশলা, পাঁচফোড়ন এর প্যাকেটের প্রত্যেকটির আলাদা আলাদা বরণমালা, গলায় ঝুলিয়ে হকারি করতে শুরু করলে হাওড়া থেকে বারোদা পৌঁছে যেতাম। সাথে কাসুন্দি, আচার, গবিন্দভোগ চাল, চিচিঙ্গা, ঝিঙে, বরবটি ইত্যাদি ইত্যাদি। ট্রলির একটা হ্যান্ডেল হাওড়া স্টেশনে পৌঁছানোর আগেই ছিড়ে গেল, আরেকটা আনন্দ এ পৌঁছে।
কিন্তু এই সমস্ত কিছুকেই ছাপিয়ে আরো একটা জিনিস ছিল, যা স্ক্যানারে দেখে হুট করে জঙ্গি সন্দেহে পুলিশ হেফাজতে নিয়ে নেওয়ার হাই চান্স। খান বিশেক গন্ধরাজ লেবু তো না, যেন কুড়িটা হ্যান্ড গ্রেনেড। বাগুইআটি ও হাওড়া থেকে বাছাই করে কেনা, গাম্বার্ট সাইজ। দড়ি দিয়ে বেঁধে গলার দু পাশে ঝুলিয়ে নিলে ও দু হাতে দুটো চিচিঙ্গা ঝিঙে নিয়ে নিলেই "মা তুঝে সালাম" এর সানি দেওল। গলায় গ্রেনেডের মালা আর দু হাতে দুটো স্টেনগান নিয়ে কেউ চাইতে এলে বললেই হল "দুধ মাঙ্গোগে তো ক্ষীর দেঙ্গে, লেকিন এক ভি চিজ মাঙ্গোগে তো চীর দেঙ্গে।"
তা সেই গোটা কুড়ি হ্যান্ড গ্রেনেড ইয়ে মানে গন্ধরাজ লেবু দিয়ে এক সপ্তাহ ধরে পান্তা ভাত, মুসুর ডাল থেকে ঘোল সব কিছু খাওয়ার পরেও বেশ কিছু অবশিষ্ট ছিল।
ঈদের দিন বাপে মেয়েতে খাবো বলে বাড়িতে রাখা ছিল কিছুটা চিকেন (মহারানীর মটন)। সকাল সকাল হঠাৎ প্রস্তাব পেলাম, "চিকেন টা দিয়ে তোমাদের গন্ধরাজ চিকেন বানিয়ে দেব?" এ যে সোডা না চাইতেই হুইস্কি!! কিন্তু, মাইন্ড ইট, বউএর কথা হ্যাঁ না যেটাই বলুন, সেটাই রিস্কি। এদিক ওদিক চোখ ঘুরিয়ে, আবহাওয়া টা অনুমান করার বৃথা চেষ্টা করে শেষ অবধি "রেসিপি আছে? না কাউকে জিজ্ঞেস করব?" বলেই দেখলাম আমার চন্দ্রকলা, বলিউডের শশিকলার মত তাকিয়ে। ঈদের দিনে সবার সাথে সবার কোলাকুলি হলেও আদা আর কাঁচকলার তো সে সম্পর্ক নেই, তাই ব্যাপারটা সেদিকে যাওয়া থেকে আটকাতে হল।
"না, তুমি তো চিকেন খাও না, তাই বললাম। তোমার রান্না নিয়ে নতুন করে তো বলার কিছু নেই, চিকেন বলেই বললাম।"
"কেন? আমি পারবো না?"
"পারবে না কেন? রজনীকান্ত সিনেমায় আর তুমি রান্নায়, পারো না এমন কিছু আছে? গন্ধরাজ লেবু আর চিকেনের দিকে তাকালেই তোমার চোখের আগুনে খাবার রেডি হয়ে যাবে, সে কি আর আমি জানি না!! কিন্তু ওই থালাইভা যেমন কিছু কিছু স্টান্ট, ওভার ডোজ হলে, নিজেই এডিট করে দেয়, তুমিও রান্না চেখে এডিট করে নিতে পারো, কিন্তু চিকেনের বেলায় তো সেটা সম্ভব না, তাই আর কি?"
"ঠিক আছে, দেখি কি রেসিপি জোগাড় করো!"
"কেন? আমি পারবো না?"
"পারবে না কেন? রজনীকান্ত সিনেমায় আর তুমি রান্নায়, পারো না এমন কিছু আছে? গন্ধরাজ লেবু আর চিকেনের দিকে তাকালেই তোমার চোখের আগুনে খাবার রেডি হয়ে যাবে, সে কি আর আমি জানি না!! কিন্তু ওই থালাইভা যেমন কিছু কিছু স্টান্ট, ওভার ডোজ হলে, নিজেই এডিট করে দেয়, তুমিও রান্না চেখে এডিট করে নিতে পারো, কিন্তু চিকেনের বেলায় তো সেটা সম্ভব না, তাই আর কি?"
"ঠিক আছে, দেখি কি রেসিপি জোগাড় করো!"
বিশ্বাস করুন, ফেসবুকের গ্রুপ সার্চ অপশন যে এত বাজে হতে পারে, জানা ছিল না। একটাও পোস্ট খুঁজে না পেয়ে শেষ পর্যন্ত তিনজন কে ইনবক্স করলাম, যাদের কোনোকালে গন্ধরাজ চিকেন পোস্ট করতে দেখেছিলাম বলে মনে পড়ল।
দুজন পাঠিয়ে দিল তৎক্ষণাৎ, আরেকজন উত্তরই দিলো না মাইরি। যা হোক, আমি দুটো রেসিপিই পাঠিয়ে দিলাম মহারানী কে। কিন্তু গন্ডগোল হল একজনের টায় একস্ট্রা পোস্ত বাটা দেওয়া।
দুজন পাঠিয়ে দিল তৎক্ষণাৎ, আরেকজন উত্তরই দিলো না মাইরি। যা হোক, আমি দুটো রেসিপিই পাঠিয়ে দিলাম মহারানী কে। কিন্তু গন্ডগোল হল একজনের টায় একস্ট্রা পোস্ত বাটা দেওয়া।
মহারানী কে দেখলাম পোস্ত র সাথে কাজু ও নিল বাটতে। ভাবখানা এমন, "আমায় কি রাজ চককোত্তি পেয়েছ, যে তেলেগু বা পুরোনো বাংলা সিনেমার স্ক্রিপ্ট পাঠাবে আর আমি হুবহু কপি করে দেব!!!! আমি চিজিত (ক্যা চিজ, কাট পিস), স্ক্রিপ্ট গুলো টুকবো ঠিকই, কিন্তু একটু কিছু নিজের মালমশলা মিলিয়ে এমন চালাবো, যে ভাওয়াল, সরি বাওয়াল না হয়।"
রান্না করার স্টাইলটা অবশ্য একঘর ছিল। রাজকুমারী যেমন তার মায়ের চাহনি দেখলেই বালিশ কোলবালিশ চাদর নিয়ে শুয়ে পড়ে, চিকেন কেও দেখলাম দই, অল্প আদা রসুন বাটা, লেবুর রস ও গোলমরিচ গুলোর কে নিয়ে শুয়ে পড়ল। আমি কিছু বললেই তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেও রান্নার তেলে গোটা গরমমশলা ফোড়ন দিতেই বাতাসে প্রেমের সৌরভ। তাতে পেয়াজ বাটা ও আদা রসুন বাটা দিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতেই দেখি চিকেন ঘুম থেকে উঠে পরেছে। দুপুরে ঘুম থেকে উঠেই যেমন একছুটে বাইরে খেলতে চলে যেতাম, চিকেন টাও সেইভাবে গিয়ে কড়াই এ পড়ল। ডেকে নিল কাজু পোস্ত বাটা কে সাথে। গরমের সময়, মাঠে ঘাটে খেলে ঘেমে নেয়ে সেদ্ধ হয়ে গেল মাইরি। তাই খেলা শেষে একটু লেবুর সরবতের মত দেখি চিকেন টাকেও মহারানী একটু গন্ধরাজ লেবুর রস ও কিছু লেবুর টুকরো দিয়ে ঢাকা দিয়ে দিল।
খেতে খুব ভালো হয়েছিল, শুধু গোল বাঁধলো এক জায়গায়। যে তিনজনের কাছে রেসিপি চেয়েছিলাম, তার একজন পুরুষ এবং তিনি উত্তর দেননি। যে দুই মহীয়সি রেসিপি দিলেন, তার একজনকে মহারানী চেনেন, ননদ বলে কোনো টেনশন নেই। কিন্তু আরেকজন তো আমার ফ্রেন্ডলিস্টে নেই, এবং আপনি আজ্ঞা করে কথা কয়েছেন ও প্রম্পট উত্তর দিয়েছেন দেখে মহারানী গন্ধরাজ লেবুর জায়গায় অন্য গন্ধ খুঁজে চলেছেন বিগত চার দিন ধরে।
সুব্রত চৌধুরী
Comments
Post a Comment