চিত্রনাট্য


চিত্রনাট্য।।

Disclaimer - The incidents and characters are a work of fiction and Resemblance to any person living or dead is purely coincidental.

অতীতের নামকরা হিরোইন ও আজকের নামী ফিল্ম ডাইরেক্টর শ্রীমতী অদিতি সিনহা, আজ নিজের ড্রইং রুমে বসে, হুইস্কির গ্লাসটা শক্ত করে ধরা ডান হাতে। এমনিতে চার পাঁচ পেগে ওনার নেশা কোনোকালেই হয় না, কিন্তু আজ কেমন যেন পুরানো কথাগুলো মনে পড়ছে। নেশা হয়েছিল সেদিন, মুখ্যমন্ত্রীর সাথে দেখা করে খালি হাতে ফিরেছিলেন যেদিন। সেদিনের পর যেমন কিছু বিবৃতি দিতে হয়েছিল, আজও সেরকম একটা বিবৃতি দিয়েই বাড়ি এসেছেন। নিজের সিনেমার মতই ফ্ল্যাশব্যাকে চলে গেলেন উনি, বছর পনের পিছনে।
----------------- * -------------------------
রাজ্যটার ব্যবসা বাণিজ্য নিয়ে দুর্নাম বহুদিনের। অবশ্য সাহিত্য, সংস্কৃতি, সিনেমা তে সুনামটা এখনও কিছুটা রয়ে গেছে। রাজ্যের নতুন মুখ্যমন্ত্রী শ্রী বোধিসত্ত্ব ব্যানার্জি তাই এবার জোর দিয়েছেন ভারী শিল্পে বিনিয়োগ আনার, যাতে রাজ্যবাসীর জন্যে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যায়। নিজে সিনেমা সাহিত্য প্রেমী, সংস্কৃতি দপ্তরও নিজের হাতে তবুও ওই সব খাতে সরকারি খরচে রাশ টেনে ধরেছেন শক্ত হাতে।
এবং সেই জন্যেই শ্রীমতী সিনহার নতুন সিনেমার প্রযোজনার প্রপোজাল টা রিজেক্ট করে দিয়েছে রাজ্য সরকারের তথ্য সংস্কৃতি দপ্তর। এত কাল ধরে রাজ্য সরকার, পুরোটা না হলেও প্রযোজক হিসেবে একটা বৃহৎ অংশের দায়ভার নিয়ে আসছিল ওনার এবং ওনার মত আরো কিছু সিনেমা পরিচালকের। এবং ওনারা সরকারি প্রযোজনায় সৃষ্টি সুখের উল্লাসে মেতে ছিলেন। দেশ বিদেশের নানান ফিল্ম ফেস্টিভালে তার সিনেমার প্রশংসা হয়, নানান পুরস্কার ও জোটে। শহুরে শিক্ষিত দর্শকরা সেই সব সিনেমার জন্যে প্রতীক্ষা করে থাকে, সিনেমা নিয়ে পাতার পর পাতা রিভিউ বেরোয় কাগজে, সেই অদিতি সিনহার সিনেমা প্রযোজনার প্রপোজাল ফেরত পাঠিয়ে দিল রাজ্য সরকারের আমলা গুলো? এত সাহস? এখনও জানে না মুখ্যমন্ত্রীর সাথে ওনার কতদিনের পরিচয়।
পরদিন সকালে মুখ্যমন্ত্রীর পিএ'র সাথে কথা বলে বিকেলের সময় নিলেন অদিতি দেবী। চলে গেলেন সরাসরি দেখা করতে বোধিসত্ত্ব বাবুর সাথে।
"দাদা, নতুন একটা স্ক্রিপ্ট লিখেছি জানেন। এক ফ্রেঞ্চ আর্টিস্ট কে নিয়ে। আমাদের শহরে আসবে সংস্কৃতির টানে। তারপর প্রেমে পড়ে যাবে শহরটার, গাইডের ও। ইংলিশে বানাবো ভাবছি, যদি অস্কার এ নমিনেট হয়ে যায়। তবে, তথ্য সংস্কৃতি দপ্তর কে যে প্রযোজনার প্রপোজাল টা পাঠিয়েছিলাম, সেটা না রিজেক্ট করে দিয়েছে আপনার আমলারা।"
"হ্যাঁ, আমি জানি, আমাকে বলেছেন ওনারা।"
"সেকি দাদা, আমি তো প্রপোজা সাথে স্ক্রিপ্টের একটা ছোট্ট রূপরেখাও দিয়েছিলাম। আপনাকে দেয়নি সেটা? আমি বলছি দাদা, এ ছবি অস্কার না হলেও, কান, মিউনিখ, প্যারিস, টোকিও, মস্কো, প্রত্যেক জায়গা থেকে পুরস্কার নিয়ে আসবে।"
"পুরস্কার ঠিক আছে, কিন্তু ওই সিনেমা বানিজ্যিক ভাবে সফল হবে কি? না, হবে না। সাধারণ মানুষ ওই সিনেমা হলে গিয়ে দেখবে না। ফলে রাজ্য সরকার প্রযোজনা করলে সরকারি টাকাটাও ফেরত আসবে না। তাই আমায় জানিয়েই ওনারা রিজেক্ট করেছেন।"
"শিল্প ও শিল্পীর মর্যাদা কি তাহলে কিছুই নেই? আর এবার তো ইংলিশে বানাচ্ছি সিনেমাটা। দেখবেন সারা দেশে তো বটেই, বিদেশেও ছবিটা হই হই করে চলবে, সমস্ত টাকা উঠে আসবে।"
"মিসেস সিনহা, আগেরবার ও একই কথা বলেছিলেন। কিন্তু কিস্যু হয় নি। রাজ্য সরকারের কাছে এখন ফান্ডের টানাটানি। তারমধ্যে একটা সিনেমার প্রযোজনা ও তারপর বিভিন্ন দেশের ফিল্ম ফেস্টিভালে যাতায়াতের খরচা, খয়রাতির সমান। আপনি যদি এতই কনফিডেন্ট থাকেন যে ছবিটা বানিজ্যিক ভাবে সফল হবে, তাহলে ব্যাংকের কাছে যান। এখন তো অনেক ব্যাংকই সরাসরি প্রযোজনা করে।"
"না মানে, ব্যাংকের কাছে গেলে তো গ্যারান্টি চাইবে। যদি শেষ মেষ সিনেমাটা একটু এদিক ওদিক হয়ে যায়, তাহলে তো এই বয়সে এসে রাস্তায় থাকতে হবে।"
"কিন্তু সিনেমা করার থেকেও আমাদের সরকারের কাছে রাজ্যের ভবিষ্যত্ প্রজন্মের জন্যে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা বেশি জরুরি। একটা সিনেমা প্রযোজনা করার থেকে একটা শিল্প সম্মেলন করে যদি রাজ্যে কয়েক হাজার কোটির লগ্নি আনা যায়, সেটা বেশি দরকারি। মাফ করবেন, এই মুহূর্তে আমাদের সরকার কোনো সিনেমা, থিয়েটার, সাহিত্য - চারুকলা একাডেমী কে নতুন করে অনুদান দেবে না।"
"আপনি তাহলে প্রযোজনা করবেন না?"
"না, জনগণের টাকায় ব্যাক্তি কেন্দ্রিক অনুদান আমাদের সরকার দেবে না।"
"দাদা, কাজ টা কিন্তু ভালো হল না। আমরা কিন্তু আফটার অল বুদ্ধিজীবী, সংস্কৃতির ধারক বাহক।"
"মিসেস সিনহা, আপনি আসতে পারেন। নমস্কার।"
--------------------------
অদিতি সিনহার সিনেমা প্রযোজনার প্রস্তাব রাজ্য সরকার নাকচ করে দিয়েছে, মুখ্যমন্ত্রী মুখের উপর না বলে দিয়েছে, এই খবরটা পেজ থ্রির সেলিব্রিটিদের মধ্যে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ল মুহূর্তে। সেক্রেটারিয়েট থেকে বেরোতে বেরোতেই মোবাইলে ফোন এলো শ্রাবণী মুখার্জির। ওনার থিয়েটারের জন্যে সরকারি হল বা মঞ্চ, ফ্রীতে বরাদ্দ করাও বন্ধ করে দিয়েছে রাজ্য সরকার।
"অদিতি দি, আজ রাতে আমার বাড়িতে একটা ছোট্ট প্রাইভেট পার্টি আছে।"
"আমার মেজাজ ভালো নেই"
"আমি জানি, পুরোটাই শুনেছি। তাই জন্যেই তো ডাকছি। আরো বেশ কিছু লোকজন আসবে। গ্লেনফিডিচ খাওয়াবো, চলে আসো, লাভ আছে।" বলেই ফোনটা কেটে দিল শ্রাবণী।
যাবো কি যাবো না করেও শেষ অবধি অদিতি সিনহা, শ্রাবণী মুখার্জির নিমন্ত্রণ ফেলতে পারলেন না।
------------------------------------------
শ্রাবণী মুখার্জির বাড়িতে আজ চাঁদের হাট। মিসেস সিনহা ছাড়াও থিয়েটার আর সাহিত্য জগতের বেশ কিছু পরিচিত মুখের ভিড়। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চিত্রকর শ্রী শ্যামলকৃষ্ণ বটব্যাল মধ্যমণি হয়ে বসে আছেন। লোকে অবশ্য ওনাকে পিছনে কোকিল শিল্পী বলেন, শুধু কোকিল আঁকেন বলে না, কোকিলের মত সুবিধাবাদী বলেও ওনার খুব দুর্নাম। এতদিন রাজ্য সরকারের চারুকলা ইন্সটিটিউটের প্রধান হিসেবে করে কম্মে ভালোই চালাচ্ছিলেন, কিন্তু ওই বোধিসত্ত্ব বাবুর শিল্পী সত্তার জায়গায় যবে থেকে শিল্প বাণিজ্য সত্তা জেগে উঠেছে, ওনার ও বারোটা বেজেছে। শহরের বুকে একটা একাডেমী বানাবেন বলে কয়েক বিঘা জমি শিল্পী কোটায় ফ্রীতে পাওয়ার ব্যবস্থা প্রায় পাকা করেই ফেলেছিলেন, মুখ্যমন্ত্রী ও তার নগরোন্নয়ন মন্ত্রী অলোক বাগচী মিলে সেটাকে আটকে দিয়েছে। উল্টে সিআইডি এখন তার চারুকলা ইন্সটিটিউটের প্রধান থাকাকালীন দুর্নীতির তদন্ত চালু করেছে।
এদের সাথে এমনই করে কম্মে খাওয়া আরো কিছু থিয়েটার টেলিভিশন এর আর্টিস্ট, কৌস্তভ সরকার, কবি সুশান্ত সেনগুপ্ত, জনার্দন গুপ্ত সবাই হাজির। সিঙ্গেল মল্ট আর স্কচের গ্লাসের ঠোকাঠুকি র শব্দ ছাপিয়ে ধীরে ধীরে আলোচ্য বিষয় এক জায়গায় এসে ঘনীভূত হল, মুখ্যমন্ত্রী বোধিসত্ত্ব ব্যানার্জি। প্রত্যেকেরই ক্ষোভ ওনার প্রতি, কারণ এতদিনের পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা গুলো বন্ধ করে দিয়েছে। স্বার্থে ঘা লেগেছে সবার।
কোকিল শিল্পী বটব্যাল বাবু দ্বিতীয় পেগটা শেষ করে বলে উঠলেন "এই মুখ্যমন্ত্রী থাকলে আর আমাদের করে খেতে হবে না। রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষার বাটি নিয়ে বেরোতে হবে।"
"এই লোকটাকে জাস্ট সহ্য করতে পারছি না আমি। এত সুন্দর একটা স্ক্রিপ্ট, ন্যাশনাল আওয়ার্ড তো বাচ্চা, কান আর বার্লিন থেকেও পুরস্কার পাক্কা ছিল। আর তারপরেও আমাকে, অদিতি সিনহা কে না বলে দিল। আই ওয়ান্ট টু থ্রো দিস ম্যান আউট অফ হিস চেয়ার, বাই হুক ওর বাই ক্রুক, রাইট নাও।" তৃতীয় পেগ টা প্রায় বটম আপ এর ভঙ্গিতে শেষ করে বলে উঠলেন অদিতি সিনহা।
"সেই জন্যেই তো তোমাদের সবাইকে ডেকেছি আজকে। একজন আসছেন, তোমাদের সাথে কথা বলতে চান, এই ব্যাপারে।" শ্রাবণী মুখার্জি সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন।
"কে?"
"মানস রুদ্র। বিরোধী দল, জনগণতান্ত্রিক পার্টির সেকেন্ড ইন কম্যান্ড।"
উপস্থিত সবাই একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলো। লোকটি মহা ঘোরেল, নামেও "ম", আর সব রকম "ম"এর দোষ বর্তমান। মাথার উপর নেত্রী মালবিকা বসুর হাত না থাকলে আজও হয় তো কৃষ্ণপুরের রেল ইয়ার্ডের লোহা চুরি করেই কাটাতে হত জীবনটা। তবে হ্যাঁ, সাংগঠনিক শক্তি আছে লোকটার, এটা মানতেই হবে। মালবিকা বসুর জনপ্রিয়তা কে কাজে লাগিয়ে পার্টিকে প্রধান  বিরোধী দলের জায়গায় নিয়ে আসার পিছনে এনার অবদানও আছে।
---------------------x------------------------------------
কথাটা শেষ হতেই, দরজায় কলিং বেলের শব্দ। মানস বাবুর সাথে গায়ক নব্যেন্দু ও রয়েছে।
"সোডা না জল?"
আরো দুটো গ্লাসে গ্লেনফিডিচ ঢেলে অতিথি আপ্যায়নে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন শ্রাবণী মুখার্জি।
বরফ ভাঙার কাজটা শুরু করলেন নব্যেন্দূ চ্যাটার্জী। এক মুঠো সল্টেড কাজু মুখে ফেলে অদিতি সিনহা কে বলল "দিদি, আপনার ব্যাপারটা শুনলাম। আপনি হলেন আমাদের দলের লেটেস্ট সদস্য। এবার কিছু একটা করতেই হবে।"
"কি করবে শুনি? সিএম এখন দিকে দিকে কল কারখানা তৈরি করে রাজ্যদ্ধার করতে ব্যস্ত, সবাই মিলে বললেও কিস্যু হবে না। তোমাদের আর কি? গানের ক্যাসেট বা থিয়েটার নামাতে যা খরচ, ও দু একটা জলসা বা ফাংশান করলেই উঠে আসবে। কিন্তু আমার তো আর সে উপায় নেই, সিনেমার বাজেট বিশাল।" ঝাঁঝিয়ে ওঠেন অদিতি সিনহা।
"সেই জন্যেই তো সবাই কে এখানে ডেকেছি দিদি" বলে ওঠে শ্রাবণী। "নব্যেন্দূ বললে ইয়ং জেনারেশন প্রভাবিত হবে, কৌস্তভ, সুশান্ত দা, জনার্দন, আমি বললে মধ্যবয়স্ক শিক্ষিত ও সুশীল বাঙালি সমাজে কিছুটা প্রভাব পড়বে। কিন্তু বটব্যাল দা ও তুমিও যদি আমাদের সাথে যোগ দাও তাহলে বয়স্ক বাঙালিদের মধ্যে ও প্রভাব বিস্তার করা সহজ হবে। তাছাড়া তোমার গ্রহণযোগ্যতা আমাদের সবার চাইতে বেশি, অতীতের ড্রিম গার্ল আজকের খ্যাতনামা পরিচালিকা, এফেক্ট টা অনেক বেশি হবে।"
"প্ল্যানটা কি একটু শুনি?" চতুর্থ পেগ টাতে এক চুমুক দিতে দিতে বললেন অদিতি দেবী।
"মানসদা, আপনিই বলুন।"
এতক্ষনে গলা খাখারি দিয়ে আসরে নামলেন বিরোধী দলের নেতা মানস রুদ্র। যা বললেন, মোদ্দা কথা হল, বোধিসত্ত্ব বাবুর (সমাজতান্ত্রিক পার্টির) সরকারকে বিপাকে ফেলে পরবর্তী নির্বাচনে জয়লাভ করার এক অভিনব প্ল্যান। হাবিবপুর জেলার শিতলাতলায় যে কৃষিজমি অধিগ্রহণ করে বিশাল অ্যালুমিনিয়াম ফ্যাক্টরির কাজ চালু হয়েছে, সেখানে ভাগ চাষী ও ক্ষেত মজুরদের ক্ষোভ আছে। তাদেরকেই অনিচ্ছুক চাষী ও জমি মালিক বানিয়ে ক্ষোভটা উস্কে দিয়ে পাবলিকের কাছে বোধিসত্ত্ব বাবুর সরকার ও পার্টিকে ভিলেন বানিয়ে দিতে হবে। নৃসিংহপুরে যে স্টিল ফ্যাক্টরির বা পশ্চিমগড়ে যে সিমেন্ট কারখানার তোড়জোড় চলছে, সেখানেও একইভাবে লোককে খেপিয়ে তুলতে হবে, তাদের ভিটে মাটি কেড়ে নিচ্ছে বলে। তারপর ধীরে ধীরে এটা সারা রাজ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে। এবং এই কাজেই আজকের নিমন্ত্রিত সকল লোকজনের সাহায্য চান রুদ্র বাবু। বদলে, প্রত্যেকের যা যা আর্থিক সাহায্য দরকার, তার ব্যবস্থা উনি করে দেবেন?
"আবসার্ড!! আমরা বললেই লোকে মেনে নেবে? আর আমাদের যা যা দরকার, তার ব্যবস্থা কি করে করবেন শুনি? আপনার নেত্রী, মালবিকা বসু জানেন আপনার এই প্ল্যান?" বলে ওঠেন অদিতি।
"জানে ম্যাডাম, জানে। আপনারা রাজি হলে আপনাদের সাথেও দেখা করবেন মালবিকা দেবী। আর বিশ্বাস করার কথা বলছেন? মিডিয়া আছে তো, টাকা দিলে সব হয়। গোয়েবলস এর তত্ত্ব টা মনে করুন শুধু।"
"কিন্তু মিডিয়া থেকে শুরু করে লোকাল পাবলিক, সবাইকে হাত করতে হলে তো বিশাল টাকার ব্যাপার, তার সাথে আমাদের ও প্রাপ্য আছে। এতসব কি ভাবে অ্যারেঞ্জ হবে?" চিন্তাগ্রস্ত ভাবে বলে ওঠেন বটব্যাল বাবু।
"আমাদের সাথে অনেকে আছে। শিল্পপতি রোহিত ভাল্লা আছে, ও ফান্ডিং করবে, কারণ এখানে অ্যালুমিনিয়াম ফ্যাক্টরি হলে ওর ব্যবসার ক্ষতি। দেশের এই দিকটায় ওর একচ্ছত্র আধিপত্য, এখানে সুমিত সিংহল এর কোম্পানি যদি সস্তায় জিনিস ছাড়ে বাজারে, তাহলে ওনার ব্যবসা মার খাবে। এছাড়া অন্য রাজ্যের লোকজন ও আছে, সেখানকার রুলিং পার্টি ব্যবসায়ীদের থেকে ফান্ডিং করিয়ে দেবে। এখান থেকে যদি প্রজেক্ট গুলো তাড়ানো যায়, তাহলে সেগুলো ওই রাজ্যে গেলে সেখানে ব্যবসায় জোয়ার আসবে, রাজ্যের উন্নতি হবে। এর বাইরেও বিদেশ থেকে ফান্ড আসবে। এই ব্যানার্জি বাবুর সমাজতান্ত্রিক পার্টির সরকারকে কেউ দেখতে চায় না। এদের জন্যে সারা বিশ্বে ব্যবসা মার খাচ্ছে।"
"কিন্তু এই শিল্পগুলো হলে তো রাজ্যের অনেক উন্নতি হবে। তাহলে?" জিজ্ঞেস করে অভিনেতা কৌস্তভ।
"তাতে কি আপনার কোনো লাভ হবে? এরাজ্যের পাবলিককে এতদিন ওরা বোকা বানিয়েছিল, এখন এসেছে উদ্ধার করতে!! শুনুন, কিছু উগ্রবাদী দলবল অলরেডি সলতে পাকিয়েই রেখেছে। আপনাদের সাথে তো তাদের পুরানো দোস্তি। এগিয়ে আসুন, আমরাও আপনাদের ব্যাপারটা দেখবো।"
"কি রকম?"
"দেখুন অদিতি দেবী, আমাদের নেত্রী মালবিকা বসুর সাথে এখনও কেন্দ্রীয় সরকারে ক্ষমতাসীন দলের ভালো সম্পর্ক। আপনি চাইলে আপনার ফিল্ম প্রযোজনা টা ন্যাশনাল ফিল্ম ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউট কে দিয়ে উনি করিয়ে দেবেন। শ্রাবণী দেবী বা কৌস্তভ বাবু, আপনাদের থিয়েটার প্রযোজনার টাকা আমরা দেব। বটব্যাল বাবু, সুশান্ত বাবু, জনার্দন দা, বা নব্যেন্দু, এদের সবার সাথে আপনাদেরও একটা ভালো আর্থিক ব্যবস্থা করে দেওয়া হবে। মিডিয়া তে বিতর্ক সভা বসিয়ে আপনাদের বক্তা হিসেবে ডাকবে আমাদের ঠিক করা নিউজ চ্যানেল। সেখানে গিয়ে বোধিসত্ত্ব বাবুর সরকারের বিরুদ্ধে আপনারা বলবেন। এবং প্যানেলিস্ট হিসেবে লিগ্যাল ওয়ে তে আপনাদের সাম্মানিক দক্ষিণা দেবে, আপিয়ারেন্স প্রতি হাজার পঁচিশ। সপ্তাহে একবার হলেও, মাসে এক লাখ।  আড়াই বছর বাদে লোকসভা ভোটে যদি আমরা বেশ কিছু সিট জিততে পারি আপনাদের প্রচেষ্টায়, তাহলে সরকারে যোগ দিতে পারব। এবং সেক্ষেত্রে আপনাদের বিভিন্ন কমিটি গঠন করে তাতে পার্মানেন্ট বন্দোবস্ত করে দেওয়া হবে। নেতাদের আশ্বাস বলে গুল ভাববেন না, আমাদের লক্ষ্য সাড়ে চার বছর বাদে বিধানসভা নির্বাচন। আর এর বাইরে যে খানে যেখানে ধর্না বা বিক্ষোভ দেখাতে যাবেন, তার সব খরচ তো আমাদের। রোহিত ভাল্লা তো বলেই দিয়েছে, আলপিন থেকে এলিফ্যান্ট, ইয়ে মানে বিসলেরি থেকে বিএমডব্লিউ বা মোমবাতি থেকে মদের বোতল, সব খরচ ওনার।"
সেদিনের মত মানস বাবুকে বিদায় দিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনায় বসলেন সবাই। নীলাচলে মহাপ্রভুর মত দোলাচলে মহাঘাঘুরা। মদের নেশায়, টাকার লোভে, প্রতিহিংসার বশে এগোতে গিয়েও বিবেকের তাড়নায় যেন কিছুটা পিছুটান। কৌস্তভ বিবেকের দংশনের কথা তুলতেই টলমল পায়ে সোফা থেকে উঠে দাড়ালেন অদিতি সিনহা। কাঁচের গ্লাসটা দেওয়ালে ছুড়ে ভেঙে বলে উঠলেন " ডু হেল উইথ ইয়োর বিবেক!!! আই ওয়ান্ট টু কিল বোধিসত্ত্ব রাইট নাও, নাও, নাও............." বলতে বলতে জীবনে প্রথমবার মদ খেয়ে বেহুস হয়েছিলেন।
---------------------------------x------------------------------
পনেরো বছর আগের ঘটনাটা মনে পড়তে, আজ যেন হাত থেকে গ্লাসটা একটু হলে নিচে পড়ে যাচ্ছিল। এত বছর বাদে আবার একটু যেন নেশা ধরছে। একা একাই আরেক পেগ বানিয়ে নিয়ে বসলেন। সেদিনের পর বছর পাঁচেক তো মদের নেশা করতে হয় নি, ছিল ক্ষমতার নেশা, অর্থের নেশা, প্রতিহিংসার নেশা। কি না করেছিলেন, কি ভাবেই না  সব সংগঠিত হয়েছিল, ভাবলে আজও হাসি পায়।
চার দিন বাদে স্বয়ং মালবিকা বসু এসেছিলেন অদিতি দেবীর বাড়িতে। এনএফডিআই এর থেকে ওনার ফিল্মের প্রযোজনা করা হবে, সেই চিঠি হাতে নিয়েই। তারপর তো ইতিহাস।
আন্দোলনে জোয়ার আনতে রাতের অন্ধকারে নিজেদের দলের সমর্থকদের বাড়িতেই আগুন লাগানো, সমর্থকের কন্যা কে ধর্ষণ, উগ্রবাদী দলবল কে দিয়ে পুলিশ ও সাধারণ মানুষ খুন, কি হয়নি। তার সাথে পাল্লা দিয়ে চলেছে শিতলাতলায় অ্যালুমিনিয়াম ফ্যাক্টরির সামনে রাস্তা আটকে ধর্না, শহরের রাজপথে মোমবাতি মিছিল, নৃসিংহপুরে গিয়ে রাস্তা কেটে ও পুলিশ খুনের সপক্ষে গ্রামবাসীদের স্বাধীনতা তো রাতের অন্ধকারে উগ্রবাদীদের সাথে ধান্ধাবাজদের মিটিংয়ে মধ্যস্থতা করা, কি ধকল টাই না গেছিল। তার সাথে আবার নিয়ম করে সপ্তাহে এক দুদিন টিভিতে সুশীল সমাজের প্রতিনিধি হয়ে নীতিকথা বলা, উফফ ভাবতে ভাবতেই পঞ্চম পেগ টা শেষ করলেন অদিতি সিনহা।
এবং সাথে সাথে বেজে উঠলো ফোনটা। ওপারে শ্রাবণী।
"কি ব্যাপার!! মালবিকা বসু কে মুখ্যমন্ত্রী বানিয়ে তো সবাই মুখে কুলুপ এঁটে আর হাতের মোমবাতির আগুন নিভিয়ে এত বছর কাটিয়ে দিলাম। হঠাৎ আজ তোমার বিবেক জেগে উঠলো নাকি, যে বোধিসত্ত্ব বাবুর প্রশংসা করলে?"
"কেন? তাতে কি হয়েছে?"
"হাওয়া ঘুরছে জানি, কিন্তু তুমি যেদিকে ঘুরছো সেদিকে না। বললাম সেদিন, রুদ্র বাবু নিজের পার্টির জন্যে একই কথা বলতে এসেছিলেন, তুমি পাত্তা দিলে না। উল্টে ডুবন্ত নৌকায় চাপতে চললে দেখছি।"
"তুই থাক তোর রুদ্র বাবুকে নিয়ে। আমায় ছেড়ে দে।" ধরা গলায় কথা গুলো বলে ফোনটা রেখেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন অদিতি সিনহা।
---------------------------*-------------------------
না, অ্যাক্টিং টা এখনও ভোলেননি উনি, না চিত্রনাট্য। শ্রাবণী, মানস বাবুর দলে ভিড়েছে, তাই ওকে দলে টেনে লাভ নেই। মালবিকা বসু ফোন করেছিল আজকে, কথা দিয়েছেন নতুন সিনেমাটা রাজ্য সরকারই প্রযোজনা করবে এবার। তাই এক ঢিলে দুই পাখি মারলেন আজ। মৃতপ্রায় সমাজতান্ত্রিক পার্টির সম্পর্কে ভালো ভালো কথা বলে জনগণের চোখে পাপস্খলন আর মালবিকা বসুর জন্যে বিরোধী ভোট ভাগ করা, দুটোই হল। বটব্যাল ও আর দুএকজন কে টানতে পারলেই খেলা জমে যাবে আবার।
চিত্রনাট্য টা খারাপ হয় না আজও ........................
©সুব্রত চৌধুরী



Comments

Popular posts from this blog

কার্তিক পুজো ও খাওয়াদাওয়া

তালশাঁস সন্দেশ

পুজো ও বামুন