দু টাকার ফুটানি
ছোটবেলায় (আশির দশকে) এই একটি নোট পকেটে থাকলে নিজেকে রাজা মনে হত। ক্রিকেটের সময় হলে একটা নর্মাল রাবারের বল পাঁচ সিকি (₹১.২৫), রাবার ডিউস বল দেড় টাকা আর ক্যাম্বিস বলের দাম ছিল পাক্কা দুটাকা। (সুব্রত চৌধুরী) ঘুড়ি ওড়ানোর মরশুমে এই টাকায় আগে এক ডজন ও পরের দিকে দু গন্ডা (আটটা) একতে ঘুড়ি পাওয়া যেত।
বাগুইআটি থেকে এয়ারপোর্ট এর বাসভাড়া ছিল ৩৫ পয়সা। সপ্তাহে দু দিন স্কুলে একা আসা যাওয়ার অনুমতি ছিল, তাই বৃহস্পতিবার পেতাম একটা এই দু টাকার নোট। চার বারের আসা যাওয়া মিলিয়ে খরচা ₹১.৪০, হাতে থাকতো ৬০ পয়সা। সোম থেকে বুধ, মা আসতো বলে যেগুলো করতে পারতাম না, ওই দু দিন ৬০ পয়সায় সেই সখ গুলো পূরণ করতাম। (সুব্রত চৌধুরী) পুরোটা খরচা করতাম না, চার আনা করে দু দিনের বাজেট বরাদ্দ রাখতাম, আর দশ পয়সা জমানো।
ভাবছেন তো চার আনা বা পঁচিশ পয়সা দিয়ে কি করতাম? কি বা খেতাম? স্কুলের গেটের বাইরে ঠেলা গাড়ি নিয়ে দাড়াতো পঁচা দা। আলুকাবলি, আমড়া মাখা, কামরাঙা মাখা ও হরেক রকম আচারের সম্ভার ওনার সেই গাড়িতে। স্কুল পড়ুয়া দের মায়েদের বক্তব্য ছিল ওনার সব জিনিসই নাকি পঁচা, এবং খুব সম্ভবত সেইখান থেকেই ওনার এহেন নামকরণ। তাই স্বাধীন দিবস গুলোতে পঁচা দা ইস ইকুয়্যাল টু দেবদূত। চার আনা দিলেই শাল পাতায় দু চামচ আচার বা এক হাতা আলুকাবলি বা আমড়া মাখা। (সুব্রত চৌধুরী) বড়রা যতই পঁচা বলুক, এয়ারপোর্ট এলাকার সমস্ত স্কুলের সামনে টিফিন টাইম ও ছুটির সময় ঠেলা গাড়িতে বিক্রি আচার বিক্রি করে (বাকি সময় রাধাশ্রী সিনেমা হলের সামনে দাড়াতেন) পঁচা দা সেই সময় এয়ারপোর্ট আড়াই নম্বর গেটের কাছে দোতলা বাড়ি বানিয়েছিলেন।
এতো গেল ঝাল মুখ বা টক খাওয়ার গল্প। তাই বলে কি মিষ্টি মুখ হবে না একটু? না না, স্কুল থেকে বেরিয়ে সামনে কোনো মিষ্টির দোকান ছিল না। তো কি হয়েছে, কাঠের ঠ্যালা গাড়িতে ভুলভাল বানানে কোয়ালিটি লেখা আইসক্রিমের গাড়ি তো ছিল। ঠিক ধরেছেন, যেগুলো দেখালেই বাবা মা বলে উঠতো ড্রেনের জলে তৈরি, সেই গুলোর কথা বলছি। পাতি বরফের উপর চিনির সিরাপ আর কালার দেওয়া কাঠি আইসক্রীম গুলো ছিল ২০ পয়সা, যেগুলো কিছুক্ষণ চোষার পর বরফ ছাড়া কিছুই থাকতো না। (সুব্রত চৌধুরী) আম বা আনারস এর ফ্লেভার হলে চার আনা আর চকোলেট ৩০ পয়সা।
গুরুজনেরা যতই বারণ করুক, আমরা তখন বড়লোক, যাকে বলে রইস। "কোই খানা গান্দা নেহি হোতা, আউর খানা সে বড়া কোই ধরম নেহি হোতা"
আর ওই দশ কুড়ি পয়সা জমিয়ে বা রাবার ডিউস বল কিনে বাকি আট আনা জমিয়ে জমিয়ে যখন দু টাকা পকেটে নিয়ে ঘুরতে বেরোতাম, তখন তো মহারাজাধিরাজ। এগ রোল বা মটন রোল খেতে গেলে অবশ্য আরেকটু বেশি খরচ হত, (আড়াই টাকায় এগ রোল আর সাড়ে তিন টাকায় মটন রোল) তাই সেগুলো বাবা মা এর সাথে বেরোনোর জন্য তোলা থাকত। দু টাকার ফুটানি তে আমার সবচাইতে প্রিয় জিনিস ছিল দুটো। প্রথমে উদমা ঝাল দিয়ে বারো আনার ফুচকা বা চুরমুর আর তারপর পাঁচ সিকির গোল্ড স্পট কোল্ড ড্রিঙ্কস।
অনেকদিন বাদে একটা দু টাকার নোট পেয়ে মেয়েকে দেখিয়ে কথাগুলো বললাম। অনেকক্ষন ধরে অবাক বিস্ময়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল নোটটা। শেষ অবধি মহারানী বলল, "এটা রেখে দাও, আর কদিন বাদে অকশন করলে যা পাবে, তাতে আবার দু দিন মন ভরে আচার বা আইসক্রিম খেতে পারবে।"
©সুব্রত চৌধুরী
Comments
Post a Comment