খাটিয়ে খাওয়া

ক্যাটারার আসার সাথে সাথে রান্নার ঠাকুর, ভিয়েন এগুলো যেমন উঠে গেল, তেমনই লম্বা টেবিল ও কাঠের নড়বড়ে চেয়ার এবং বালতি হাতে পাড়ার ছেলেদের / আত্মীয়দের খাবার পরিবেশন করাও হারিয়ে গেল। এবং তারই সাথে উঠে গেল সেই পরিবেশকদের জন্যে অনুষ্ঠানের দু চার দিন বাদে আয়োজিত "খাটিয়ে খাওয়া"র রীতি।

লম্বা টানা টেবিল এর একেকটাতে ৬ জন বসতে পারতো। সাথে বাচ্চা থাকলে বা ব্যাচ ফুল হয়ে গেছে কিন্তু কারোর বিশেষ তাড়া থাকলে একটু চেপে চুপে ৭ জন কেও বসিয়ে দিত লোকজন। তবে ওই কাঠের চেয়ারে বসা একটা চাপের ব্যাপার। কোনটা কখন কোনদিকে নড়ে উঠবে আর আপনাকে পাশের অতিথির গায়ে গিয়ে পড়তে হবে না টেবিলের মাটির গ্লাসের জল উল্টে ফেলে হাসির খোরাক হতে হবে, সেটা দেব না জানতি।

নতুন ব্যাচ শুরুর আগে প্রত্যেকটা টেবিলে জল ছিটিয়ে কাগজ বিছিয়ে দিতে হতো। এই কাজে মোটামুটি পরিবেশক দলের গুরুত্বপূর্ণ দুজন সদস্য থাকত, কারণ "সা" করে কাগজের রোল গড়িয়ে দেওয়া ও তারপরে শেষ প্রান্তে টেবিলের কোনায় খোঁচা দিয়ে ঘচ করে ছিড়ে ফেলা মোটেও সহজ কাজ ছিল না।
এরপর কলাপাতা / শালপাতা, মাটির গ্লাস, গ্লাসে জল ও পাতার কোনায় নুন লেবু, এইসব কাজে কিছু বাচ্চা কাচ্চা নিয়োজিত থাকত। তারপর বাকি আইটেম পরিবেশনের দায়িত্বে আবার সব পোড়খাওয়া পাবলিক। কখন রাধবল্লভিটা একটু বেশি পুশ করতে হবে, বা কখন মটন টা একটু হালকা হাতে চালাতে হবে, এ ব্যাপারে তারাই ছিলেন গৃহস্থের ভরসার পাত্র। প্যান্টের উপর গামছা জড়িয়ে, বালতি হাতে পরিবেশন করে নিমন্ত্রিতদের সন্তুষ্ট করেও গৃহস্থের ভাড়ার সামাল দেওয়ার অসামান্য পারদর্শিতা ছিল এই পরিবেশকদের।

কিন্তু সন্ধ্যে থেকে মাঝরাত অবধি এই খাবারের মধ্যে থেকে ও বারংবার পরিবেশন করে করে পরিবেশকদের খাওয়ার ইচ্ছেটাই চলে যেত। এমন নয় যে পেটে ছুঁচো ডন মারছে, কারণ পরিবেশন করতে করতে টুকটাক মুখ ঠিকই চলত, কিন্তু মাঝরাতে সব শেষ হলে তখন আর এনারা গুছিয়ে খেতে পারতেন না, অনেকেরই গা গুলোতে শুরু করত। স্রেফ পাড়াতুতো সম্পর্ক বা আত্মীয়তার জন্যেই এনারা পরিবেশন করতেন, কোনো রকম টাকা পয়সা দেওয়ার ব্যাপার ছিল না।

তাই এই পরিবেশকদের সম্মানার্থে অনুষ্ঠান মিটে যাওয়ার কয়েকদিন বাদে আয়োজিত হত "খাটিয়ে খাওয়া"। অবস্থাপন্ন বাড়ি হলে একই রান্নার ঠাকুর কে দিয়েই রান্না করানো হত, না হলে বাড়ির মহিলারাই রান্না করতেন। যেই রান্না করুক, একটা ব্যাপার একই থাকতো, সেটা হল মেনু। নিমন্ত্রণবাড়ির ভোজে যা যা মেনু ছিল, সেই সমস্ত পদ আবার রান্না করা হত। বাড়ির সবাই মিলে পরম যত্নে খাওয়াতেন পরিবেশকদের।

আধুনিকতার ছোঁয়ায় পুরানো দিনের সেই "খাটিয়ে খাওয়া" আজ কালের গর্ভে বিলীন।।

সুব্রত চৌধুরী

ছবি - অন্তর্জাল

Comments

Popular posts from this blog

কার্তিক পুজো ও খাওয়াদাওয়া

তালশাঁস সন্দেশ

পুজো ও বামুন