মটন পোড়া

"না গুরু, এমনি হলে হবে না। ওই গব্বর সিংয়ের ডেরায় মেহবুবা মেহবুবা নাচের সময়, খাসি টাকে কাঠের আগুনে যেভাবে ঝলসানো হচ্ছিল, সেই ভাবে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ঝলসানোর ব্যবস্থা করতে হবে।"

২০০৫ সাল, ডিসেম্বর মাস। বিকেল বিকেল বোলপুর স্টেশন থেকে প্রান্তিক এসে পৌঁছেছি। দিন পাঁচেকের জন্যে বাড়ি থেকে দূরে সাত আট বন্ধু মিলে হই হুল্লোড় করতে এক বন্ধুরই বাংলো বাড়ি তে আসা। ওর বাবা বিল্ডার। কেয়ারটেকার অশোক ও রান্নার জন্যে এক ঠাকুমা আছেন বাংলোতে, খোয়াইয়ের দিকে কোনো গ্রামে থাকেন। সন্ধ্যের মধ্যে রান্না করে দিয়ে ঠাকুমা চলে যায়। অশোক, দরকার থাকলে থেকে যায়, আর না হলে বেশি রাতে বাড়ি ফেরে। বাড়ি পৌঁছে ঠাকুমাকে দেখেই, এক গামলা স্যালাড কেটে আর রাতের জন্যে গোটা ত্রিশেক রুটি করে রেখে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে বললাম। অশোক অল্পবয়সি চটপটে ছেলে। দেশী চিকেনের কথা বলতেই বলল, সকালেই গোটা কুড়ি দেশী মুরগী কিনে রেখেছে, দাদাবাবুর ফোন পেয়েই। বাগানের ঘরে আছে, যতগুলো লাগবে, ও নিজেই কেটে ড্রেস করে দেবে। এহেন একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট পেলে চ্যাংরা ছেলেপুলের দল যে অতি উৎসাহী হবে, তা বলাই বাহুল্য।

কনকনে ঠান্ডায় দেশী চিকেন এর কষা, কচকচী - মেটে কষা ও স্যালাড দিয়ে সন্ধ্যেবেলা টা ভালোই জমবে ভেবেছিলাম বুড়ো সাধুর সাথে। শুরুটাও ভালোই হয়েছে। অশোক রীতিমত কাঠের স্তূপ জোগাড় করে রেখেছে, তাই দিয়ে bonfire। কিন্তু বিধি বাম। এতো সাত মাতালের মেলা। এক শিয়ালে হুক্কা হুয়া করলে বাকিরা গলা মেলায়। হঠাৎ একজনের মাথায় চাপলো, গোটা মুরগি কাঠের আগুনে ঝলসিয়ে / পুড়িয়ে খাওয়া হবে। ব্যাস, বাকিরাও তাল মেলাতে শুরু করলো।

এইবার অশোক ব্যাকফুটে। বলে, দাদাবাবু, আমি কাঠকয়লা দিয়ে একটা উনুন সাজিয়ে রেখেছি। একটা লোহার স্ট্যান্ড ও বানানো আছে, উনুনের সমান। তার উপরে রেখে পোড়ালে হবে না? জাত মাতালেরা নেশার ঘোরে কবে আর অন্যের কথা শুনেছে!!!! সবাইকে বলে বুঝিয়ে ব্যর্থ হয়ে শেষে রান্নাঘরে এসে আমার কাছে হাজির হল। টুবাইদা, বাঁচান। কাঠ দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছি, মশলা মাখিয়ে মুরগিও রেডি করে দিচ্ছি, কিন্তু ওই আগুনে মুরগি পোড়াবো কি করে?

মাতালদের প্রবলেম সলভ করার একটা সহজাত ক্ষমতা ছিল আমার। বললাম, এক কাজ কর, পাশের বাড়ি তৈরির কাজ চলছে, ওখান থেকে তিন চারটে বাটাম নিয়ে আসতে পারবি? এক্ষুনি আনছি, ওটাও তো দাদাবাবুর বাবাই বানাচ্ছেন, আমিই দেখভাল করি। সাথে তাহলে লোহা বাঁধার তাঁর নিয়ে আসিস কিছুটা। তিনটে বাঁটাম এর মাথা এক জায়গায় বেঁধে ও পা গুলোকে ছড়িয়ে তেপায়া দাড় করালাম বাগানে। তলায় একটা মশলা মাখার কড়াই রেখে তার উপর আগুন জ্বালানো হল ও মশলা মাখানো মুরগিটি বাটামের মাঝখান থেকে তাঁর দিয়ে ঝোলানো হল। মিশন সাকসেসফুল ভেবে যেই না রান্নাঘরের দিকে পা বাড়িয়েছি, ব্যাস ব্রহ্মাস্ত্র উড়ে এলো - এরকম না, মেহবুবা মেহবুবা নাচের মত চাই। একে আমি রান্নাঘরে থাকায়, বুড়ো সাধুর সান্নিধ্য কম পাচ্ছি, তার ওপর এমন আবদার শুনে সত্যি বলছি, মনে হচ্ছিল, বন্ধুটিকেই যথাস্থানে যথাযোগ্য জিনিস ঢুকিয়ে সাকলিং পিগ এর মত ঝলসে নিই। কিন্তু ততক্ষণে হুক্কা হুয়া চালু হয়ে গেছে।

শেষ অবধি আরো তিনটে বাটাম এনে আরেকটা তেপায়া দাড় করানো হল। পাশের বাড়িতে গিয়ে একটা চার পাঁচ ফুটের লোহার রড কে ঠিয়ার মধ্যে ফেলে গাড়ির জ্যাকের হ্যান্ডেলের মত শেপে বেঁকিয়ে নিলাম আমি। রডটা ভালো করে পরিষ্কার করে গোটা মুরগিটা গেঁথে রেডি করল অশোক। তারপর দুটো তেপায়ার মাঝে আগুন ও উপরে রড লাগিয়ে চালু হল শোলে স্পেশাল মাংস পোড়া।

বাগানে বক্স লাগিয়ে মেহবুবা মেহবুবা চালিয়ে একটা শোলে মার্কা ফিলিং আনার চেষ্টা করতে লাগল, পাড় মাতাল ও এই আইডিয়ার উদ্ভাবক। আমার এদিকে নেশা ছুটে রাগে ও খিদে তে মাথা গরম। হঠাৎ মাথায় আইডিয়া এলো, এতই যখন ব্যাটার শোলের ফিলিং চাই, তখন একটা সিন না হয় নিজেই অভিনয় করুক। বললাম, যা যা বলেছিলি সব ব্যবস্থা করে দিয়েছি, এবার নিজে একটু ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ঝলসে দেখাও।

আর কি, মনে করুন "আংরেজো কে জামানে কা জেলার" ঝুড়ি সরিয়ে বলছেন "তো ইয়ে হ্যায় সুরঙ্গ খোদনে কা আউজার, হা হা হা, হাম আংরেজ কে জামানে কে জেলাআআআআআ................"

ছবিতে, গতমাসে অফিসিয়াল টুরে যোধপুর গিয়ে খাওয়া, আমাদের জন্যে স্পেশালি বানানো "জংলী গোস্ত"। এটা গোটা খাসি (ছোট সাইজের) পুড়িয়ে নিয়ে তারপর পিস করে বানানো হয়, পরের প্রসেসটা অনেকটা "জংলী মাস" এর মত।

Subrata Chaudhuri

Comments

Popular posts from this blog

কার্তিক পুজো ও খাওয়াদাওয়া

তালশাঁস সন্দেশ

পুজো ও বামুন