আমার পুজো - সেকাল ও একাল (শেষ পর্ব)


 নিজ ভূম ও প্রবাস (শেষ পর্ব)

দেখতে দেখতে জীবনটা কেমন পাল্টে যেতে লাগলো। নব্বই এর দশকের শেষ লগ্নে এসে খুব দ্রুত পট পরিবর্তন হতে শুরু করলো মহানগরের দুর্গাপুজোর। বাড়তে শুরু করলো বাজেট। পুরস্কার পাওয়ার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠতে শুরু করল যেন সমস্ত পুজো কমিটি। ধীরে লয়ে সেই সুযোগ টা নিয়েই প্রবেশ করলো থিম, আজ যা বাঙালির উৎসবকেই গ্রাস করে নিল।
যাদবপুরে পড়ি তখন, তাই নিজেদের পুজো শপিং এর পীঠস্থান তখন গড়িয়াহাট। গোলপার্ক থেকে গড়িয়াহাট এর মধ্যের ফুটপাথ থেকে একটা জিন্স ও একটা টি শার্ট মানেই পুজো কমপ্লিট। কিন্তু সেটাও খেপে খেপে কেনা হতো, আজ এই বন্ধুর তো কাল আরেকজনের। কোনোদিন বেদুইন এর রোল, তো কোনদিন দাশ কেবিনের মোগলাই। কেনাকাটার সাথে সাথে খাওয়া দাওয়া টাও কমতে লাগলো। কারণ টাকা জমাতে হবে, পুজোর কদিনের জন্যে।

কুমোরটুলি থেকে ঠাকুর আনতে যাওয়ার সময় একটু বাড়তি দায়িত্ব থাকতো, আমার উপর বিশেষ করে। রঙিন দুনিয়ার লোকজনকে সামলে রাখার, শর্ত একটাই তাদের চাটের ভাগ দিতে হবে। ফলে কুমোরটুলি গেলে খাওয়াদাওয়া টা ভালোই হত, ডিম পাউরুটি থেকে অমলেট, ছোলা মাখা থেকে চিকেন পকোড়া। রাতের কলকাতায় যে এত খাবার পাওয়া যায়, সেটা মধ্যরাতের পর কুমোরটুলি না গেলে জানতেই পারতাম না। কিন্তু কিছু বন্ধু বান্ধব ও সিনিয়ারদের জন্যে মাঝে মাঝে ব্যাপারটা অসহ্য লাগত। পুলিশ থেকে শুরু করে রাস্তার সারমেয় কুলের তাড়া খেতে হয়েছে তাদের জন্যে।
ফিরে আসা যাক পুজোয়। কাজ করতাম এক প্রোমোটারের কাছে, ফলে ওই পঞ্চমী থেকেই ছুটি স্টার্ট। তখন ছুটির ব্যাপারে দিল দরিয়া সরকার না থাকলেও আমার বসের মন এই ব্যাপারে খুব দরাজ। সাথে পুজো স্পেশাল হিসেবে পঞ্চমীর দিন একটা শিভাস রিগ্যাল দিত, যদিও আমি তা খেতাম না। আমার এক বন্ধুর বাড়িতে অতি সন্তর্পনে সেটি লুকিয়ে রাখা হত অষ্টমীর সন্ধ্যের জন্যে।
রোজ সন্ধ্যেবেলা প্যান্ডেলের সামনে বসে আড্ডা ও রোল চাউমিন ফিশ ফ্রাই খাওয়া। রাত্রি নটার পর টুক করে গলতায় ঢুকে পড়া বন্ধুদের সাথে। ঢুকু ঢুকু ঢালিনির সাথে এন্তার চাট। সেই সব পর্ব মিটিয়ে তারপর নৈশ অভিযান। একদিন সাউথ তো একদিন নর্থের পুজো পরিক্রমা। বেশিরভাগ দিনই (বা রাতেই) খাওয়া দাওয়া পর্ব টা চাইনা টাউনেই হত। বিগবস নয় বেজিং। একটা জিন্স এই পুজো কাবার। কারণ পুজো বলতে তখন আড্ডা, ছুটি ও খাওয়াদাওয়া টাই মূল আকর্ষণ ছিল। থিমের ঠেলায় যবে প্রথম পাড়ার মণ্ডপে কোনো এক ফলের বীজ এর প্রতিমা দেখেছিলাম, সেদিন থেকে পুজোর প্রতি অবশিষ্ট আকর্ষণটা ও বোধহয় চলে গেল।

শুধু তো থিম না, পাড়ায় পাড়ায় সার্বজনীন বিজয়া সম্মিলনী টাও একটা রেওয়াজ হয়ে গেল। দশমীর দিন ও দর্শনার্থীদের ভিড় থাকে বলে সিঁদুর খেলা ও বরণ পিছিয়ে গেল। হয়ত পুলিশ চরমসীমা না বেঁধে দিলে, কালীপুজো অবধিও ঠাকুর রয়ে যেত প্যান্ডেলে। যেদিন ভাসান, সেইদিন বিজয়া সম্মিলনী ও খাওয়া দাওয়া ক্লাবে। হরেক রকম খাবার ও পুরো পাড়ার লোকের একত্রিত হওয়াটা, একদিকে ভালো হলেও বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিজয়ার নাড়ু মিষ্টি ঘুগনি সিঙ্গারা খাওয়ার ব্যাপারটাকে প্রাগৈতিহাসিক যুগের আচার বানিয়ে দিলো।

আর এখন। প্রবাসীর কাছে কিবা দিন কিবা রাত। রাত পোহালেই মহালয়া। যখন সবাই বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠে চণ্ডীপাঠ শুনবে, আমি তখন গাড়িতে, উদয়পুরের পথে। ঘুরতে নয়, অফিসের কাজে। শেষ পাঁচ বছরের মধ্যে একবার পুজোয় বাড়ি যেতে পেরেছিলাম। তাই একালের পুজো নিয়ে অনেক কিছু লেখার ইচ্ছা থাকলেও, কলম চলে না।

মুঠো ফোনের দৌলতে মহিষাসুরমর্দিনী এখন, যখন তখন বেজে ওঠে। পুজোয় কেনাকাটা বলতেও আগে আসে সেই স্মার্টফোন, স্ট্যাটাস সিম্বল। মা দুর্গার থেকেও বড় দেবীর দয়ায় রাজ্যে তো এখন মহালয়া থেকেই পুজো (এবার তো শুনলাম মহালয়ার আগেই)। পুজোয় ড্রাই ডে ও উঠে গেছে মনে হয়, এইট নাইনের বাচ্চাগুলোকে ও দেখলাম সেবার মদ্যপানে ব্যস্ত। পুজো কমিটির লোকজন পুরস্কারের পিছনেই ব্যস্ত। মহানগরে এখন আর দুর্গাপুজো হয় না, থিম পুজো হয়। দুর্গাপুজো টিকে আছে কিছু বাড়ির পুজোয় ও মহানগরের গণ্ডির বাইরে, মফস্বল, গ্রাম ও প্রবাসে। যেখানে আজও আচার আচরণ মেনে পুজো হয়, আজও যেখানে ঘুগনি, আলুর দম, চপ, চাউমিন, রোল, কাটলেটের দোকান থেকে পুজো প্যান্ডেলের আশেপাশে।
বাড়ি থেকে দূরে, উৎসবমুখর কল্লোলিনী থেকে দূরে থাকা প্রবাসীরা, প্রবাসের পুজোতেই নিজেদের বাঙালিয়ানা খুঁজে বেড়ায়। একটা রোল চাউমিন এর দোকান দেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছিল গতবছর, গুজরাটে। পুজো প্যান্ডেলের কাছে রোল হাতে আড্ডা মারার নস্টালজিয়া টা ফিরে এসেছিল। বাঁধা ধরা ছকে আটকে আমরা, সকালে প্যান্ডেলে প্রণাম করে অফিস। লগ্ন যেখানেই যাক, চাকুরীরত দের জন্যে গন অঞ্জলী লাঞ্চ আওয়ারে। অঞ্জলী দিয়ে ভোগ খেয়েই আবার অফিস। সন্ধ্যেবেলা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এর পর ওখানে নয় রেস্টুরেন্টে ফাইন ডাইন।
পরবর্তী প্রজন্মের জন্যে কি রেখে যেতে পারব আমরা (প্রবাসীরা) জানি না। তাদের কাছে চারদিনের দুর্গাপুজোর থেকে ন দিনের নবরাত্রি অনেক বেটার, মাচ মোর গ্ল্যামারাস।

তবু মনে রেখ - এই আশায় প্রতিবছরই বুক বাঁধি, সামনের বছর নিশ্চয়ই যাবো কলকাতা। জানি না, কি হবে, তবে মা দুর্গার কাছে প্রার্থনা করি, কাজের জন্যে নিজের ঘর থেকে দূরে প্রবাসী করে আর কাউকে পাঠিও না মা। বড় দুঃখ লাগে, এই কটা দিন, নিজের বাড়ি ছেড়ে দূরে পরে থাকতে।

©সুব্রত চৌধুরী



Comments

Popular posts from this blog

কার্তিক পুজো ও খাওয়াদাওয়া

তালশাঁস সন্দেশ

পুজো ও বামুন