আমার পুজো - সেকাল ও একাল (পর্ব ২)


পাখা গজানো পর্ব

আসতে আসতে পাখা গজালো, ইয়ে মানে কৈশোর কাল (ক্লাস এইট থেকে টুয়েলভ)। ইয়া বড় রেডিওর পাশেই ছোট ট্রানজিস্টর এলো বাড়িতে। মহালয়ার সকালে মহিষাসুরমর্দিনী শোনার অভ্যাসটা একই রইল।

পুজোর মার্কেটিং এ এক সেট জামা প্যান্টের কাপড় বাবা মা কিনে আনতেন। বাকিটা (জিন্স, টি শার্ট, গেঞ্জি, বেল্ট) বন্ধুদের সাথে কিনতে না গেলে তো প্রেস্টিজে গ‍্যামাকসিন। উড়ু উড়ু মন খুবই উতলা, তাই সকাল সকাল চলো ধর্মতলা। আর সেখানে পৌঁছেই যেন লালমোহন বাবুর উপন্যাসের সম্মুখীন, "ধর্মতলায় ধর্মসংকট"। নিউ মার্কেট, ময়দান মার্কেট, শ্রীরাম আর্কেড একদিকে ও অন্যদিকে নিজাম, আমিনিয়া, সাবির, অনাদি। Levi's এর জিন্সের দামের সাথে নিজামের রোল বা কাবাব এর দামের জোরদার হিসেব নিকেশ চলত। খ্যাটনের দিকে নজর দিতে গিয়ে সস্তায় জিন্স খুঁজে বার করতে হত। একটু বেশি সেভিংস হলেই তো সাবিরের রেজালা। সাথে দশ দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে নিয়ে টুক করে রিগ্যাল, সোসাইটি বা নিউ এম্পায়ার, লাইট হাউস, গ্লোবে (পোস্টার দেখে হল ঠিক হতো) ঢুকে পড়া। শেষের তিনটে হলে ঢুকলে পকেটে অবধারিত ভাবে টান পড়ত। তখন ডেকার্স লেন ভরসা, আর একেবারেই পকেটে টান পড়লে ধর্মতলা থেকে হাঁটতে হাঁটতে রাইটার্স বিল্ডিং। রাইটার্স বিল্ডিং এর পিছন দিকে একটা ভাতের হোটেল ছিল তখন, উড়িয়া হোটেল। প্রায় ৫০-৬০জন একসাথে খেতে পারতো। কলাপাতায় খাবার ও মাটির ভাঁড়ে জল, ২৫ টাকায় এক পিস মাছ সহ ভরপেট খাওয়া।

ধীরে ধীরে কাঁথির প্যান্ডেল শিল্পীরা কলকাতার নামকরা পুজোর গণ্ডি ছাড়িয়ে আমাদের এদিকেও উকি মারতে শুরু করলো। লোকাল ডেকরেটরদের প্যান্ডেলের কাজ বলতে বাড়ির পুজোর ম্যারাপ বাঁধাই রয়ে গেল (থিম নামক ভদ্রলোকের গৃহপ্রবেশ ঘটতে তখনও কিছুকাল বাকি ছিল)। কাঁথির ডেকরেটর ও কুমোরটুলির ঠাকুর, এইটাই কম্বিনেশন হত। আসতে আসতে বর্তালো চাঁদা তোলার দায়িত্ব। চাঁদা তোলার ব্যাপারে একটা hierarchy কাজ করত, মানে সিনিয়ার মোস্ট যারা, তারা পাড়াতেই চাঁদা তুলবে, তাদের থেকে একটু জুনিয়র আসে পাশের পাড়া আর আমরা চ্যাং ব্যাং আরো দূরের পাড়া, যেখানে একটা বাড়ি থেকে ২০ টাকা পাওয়া আর ভারতের ফুটবল ওয়ার্ল্ডকাপ এ চান্স পাওয়া এক ব্যাপার। দূরের পাড়ায় গিয়ে চাঁদা তোলার কিছু শর্ত ছিল। এক যা চাঁদা উঠবে তার ১০% দিয়ে চপ মুড়ি বা সিঙ্গারা মিষ্টি খাওয়া হবে। কারণ দূরের পাড়ায় চাঁদা তোলার অনেক হ্যাপা। প্রথমত কোন পুজো, সেটা বোঝাতেই পাঁচ মিনিট, তারপর কিছু বাড়ি তো চাঁদার নাম শুনলেই ফি বছর "কাল অশৌচ" বলে দিত, কটা যে বাপ মা কে জানে। তাই এত খাটা খাটনির পর ওইটুকু প্রাপ্য।

বাটাম এর কাজের প্যান্ডেল, তাতে ফি বছর নানান হস্তশিল্প দিয়ে ভিতরটা সাজানো, এটাই আমাদের বাজেটে সম্ভব। কুমোরটুলি থেকে ঠাকুর আনতে যাওয়া হত চতুর্থী র রাতে, নিয়ে পৌঁছাতাম পঞ্চমীর ভোরে। আর রাত্রিবেলা ঠাকুর আনতে যাওয়ার মজাই আলাদা ছিল। বাড়ি থেকে ভরপেট খেয়ে বেরোলেও, আমরা জুনিওর গ্রুপ কুমোরটুলি না গিয়ে সোজা আহিরিটোলা ঘাট। মাঝরাতে গঙ্গার ঘাটে বসে ঠান্ডা হাওয়ায় গরম গরম লিট্টি চোখা, আহা অমৃত সমান। ওখান থেকে খাওয়া দাওয়া সেরে রাস্তার কুকুরের ও "ক""পু"র নজর বাঁচিয়ে যতক্ষণে কুমোরটুলি পৌঁছতাম, সিনিয়ার রা রঙিন দুনিয়ায়। শুধু ট্রেলার ও মুটে, এই দুই ব্যবস্থা করে রেখেছেন। বাকি দায়িত্ব আমাদের ও আমাদের উপরের গ্রুপের। ট্রেলারে চেপে ভোর রাতের কলকাতা ভ্রমণ করে প্রতিমা নিয়ে আসা। ট্রামের তার বাচিয়ে কুমোরটুলি থেকে পার্ক স্ট্রিট পার্ক সার্কাস হয়ে বাইপাস ধরে উল্টোডাঙা এসে বাগুইআটি আসা, চাট্টিখানি কথা! ভোর ভোর পাড়ায় পৌঁছে ভিআইপি সুইটস খুলিয়ে সাতসকালে রসগোল্লা সাঁটিয়ে তবে বাড়ির পথ ধরতাম।

ষষ্ঠী থেকে নবমী, সন্ধ্যেবেলার রুটিনটা একটু চেঞ্জ। বাড়ি থেকে পুজোর কদিনের বাজেট বরাদ্দ একটু বাড়ত। পুজো পরিক্রমার রুট ম্যাপ বেরোত কাগজে, সেটা কেটে পকেটে রাখতে হত। সকাল বেলা প্যান্ডেলে বসেই প্ল্যান হত আজ কোথায় ঠাকুর দেখতে যাওয়া হবে। আমার আবার অল টাইম ফেভারিট ছিল বাগবাজার সার্বজনীন। শুধু পুজোর জন্যে না, ওখানে সামনে যে স্টল গুলো বসতো, তাতে একটা জম্পেশ ঢাকাই পরোটার দোকান ছিল, মাঠে ঢুকেই বা দিকে। এছাড়া রাস্তায় যেতে যেতে তো টুকটাক ছিলই। তখনও হোল নাইটের পারমিসন ছিল না, তাই রাতে বাড়ি ফিরেই ডিনার।

অষ্টমীর সকালটা একই রকম রয়ে গেছিলো। পুজোর প্যাকেট নিয়ে টোকেন দেওয়া, অঞ্জলির ভিড় ও ফুল, এবং মিষ্টি ভক্ষণ। তবে উৎসাহ টা বেশি থাকতো অঞ্জলির ফুল দেওয়ার জন্যে, স্পেশাল রিকোয়েস্ট এ বেলপাতা সহ। কারণ অনুমান করার জন্যে পুরস্কার নেই, আগেই বলে রাখলাম। তবে ওই যে পাখা গজিয়েছে বললাম। অঞ্জলী দক্ষিনা অনেকে ভিড় এর জন্যে পিছন থেকে ছুড়ে দিতেন। কিছু কিছু কয়েন তক্তার ফাঁক গলে স্টেজের নিচে। এবং মিষ্টি ভক্ষণ পর্ব শেষে স্টেজের তলায় ঢুকে সেই টাকা কুড়িয়ে তাই দিয়ে প্রথম সিগারেট, Rothman's।

ভাসানে যাওয়ার পারমিসন মিলেছিল, কিন্তু কোনো না কোনো মানবীয় সিসিটিভি যে নজর রাখছে বাবার কথায়, তা বিলক্ষণ জানতাম। তাই বেগরবাই হলে যে ছাল চামড়া এক হবে, এটা সহজেই অনুমেয়। তাই বরণের পালা শেষ করে মা ফিরলেই, সবাইকে প্রণাম করে নাড়ু নিমকি খেয়েই প্যান্ডেলে। করা ম্যান মার্কিং এড়িয়ে সেই ভাসানের সময়ই এক বন্ধু প্রথমবার জোর করে সিদ্ধি খাইয়ে দিল। কিন্তু, ছাল চামড়া র ভয়, সিধা ফুচকাওয়ালার কাছে। গলায় আঙ্গুল দিয়ে বমি করে মোটামুটি ১ লিটার তেতুঁল জল খেলাম। এবং ভাসান শেষে বাড়ি ঢোকার আগে আবার বমি করে,  মুখে চোখে জল দিয়ে তবে বাড়ি ঢুকি।

পরদিন থেকে বিজয়া। পাড়ায় সবার বাড়ি গিয়ে বিজয়ার রেওয়াজটা তখন পরতির দিকে। বুজুম ফ্রেন্ডদের বাড়ি ছাড়া অন্য কোথাও নেই। লক্ষ্মীপুজোর পর কোচিং খুললেই আসল বিজয়া চালু হত। প্রত্যেকটা টিউশনে গিয়ে স্যার দের থেকে খাওয়া, সে এক দারুণ জিনিস। কেউ দিল দরিয়া, চাউমিন মোগলাই খাওয়ায় তো কোনো স্যার শুধুই দু টাকার সন্দেশ। তবু সে জিনিসে যে ভালোবাসা ছিল, তা আজ বোধহয় আর নেই।


©সুব্রত চৌধুরী


Comments

Popular posts from this blog

কার্তিক পুজো ও খাওয়াদাওয়া

তালশাঁস সন্দেশ

পুজো ও বামুন