আমার পুজো - সেকাল ও একাল (পর্ব ১)
আমার পুজো - সেকাল ও একাল (পর্ব ১)
ছোটবেলা
"ওরে ওঠ ওঠ, পৌনে চারটে বাজে, ওঠ।"
"তুমি চালাও না, আমি শুয়ে শুয়েই শুনবো।" কাঁথাটা মুড়িয়ে কথা গুলো বলেই পাশ ফিরে আবার ল্যাদ খাওয়ার তোড়জোড় শুরু করতাম।
"আরে বাবা, চললে কি আর তোকে এত বাবা বাছা করি, এরিয়াল থেকে তাঁর খুলে পরে গেছে। কতবার তোর বাবাকে বলেছি ঘরে ইঁদুর হয়েছে, কে কার কথা শোনে। একটু টুলে উঠে ওটা লাগিয়ে শুয়ে পর, আর কিচ্ছু বলব না।"
কি আর করা যায়। শরতের ভোরে হালকা হিমেল হাওয়ায় কাঁথার মায়া ত্যাগ করে উঠতেই হল। কোনো মতে রেডিওর তাঁর খুঁজে ঘুম চোখে নড়বড়ে টুলে উঠে এরিয়েলের জালে লাগিয়ে নিচে নামতেই চালু হয়ে গেল শ্রী বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠে চণ্ডীপাঠ। আপামর বাঙালির দুর্গাপুজোর ফাইনাল কার্টেন রাইসার।
"তুমি চালাও না, আমি শুয়ে শুয়েই শুনবো।" কাঁথাটা মুড়িয়ে কথা গুলো বলেই পাশ ফিরে আবার ল্যাদ খাওয়ার তোড়জোড় শুরু করতাম।
"আরে বাবা, চললে কি আর তোকে এত বাবা বাছা করি, এরিয়াল থেকে তাঁর খুলে পরে গেছে। কতবার তোর বাবাকে বলেছি ঘরে ইঁদুর হয়েছে, কে কার কথা শোনে। একটু টুলে উঠে ওটা লাগিয়ে শুয়ে পর, আর কিচ্ছু বলব না।"
কি আর করা যায়। শরতের ভোরে হালকা হিমেল হাওয়ায় কাঁথার মায়া ত্যাগ করে উঠতেই হল। কোনো মতে রেডিওর তাঁর খুঁজে ঘুম চোখে নড়বড়ে টুলে উঠে এরিয়েলের জালে লাগিয়ে নিচে নামতেই চালু হয়ে গেল শ্রী বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠে চণ্ডীপাঠ। আপামর বাঙালির দুর্গাপুজোর ফাইনাল কার্টেন রাইসার।
আমাদের অবশ্য দুর্গাপুজোর প্রস্তুতি শুরু হত সেই রথের সময় থেকে। পাড়ার ক্লাবে বড়দের মিটিং, পুজোর বাজেট ঠিক হবে। আমাদের নজর ইটিং এ, মানে সুকুমারদার দোকানের সিঙ্গারা তে। তখন তো থিম, খায় না মাথায় দেয় কিছুই জানা ছিল না, শুধু প্যান্ডেলের আয়তন ও ভিতরে শুধু কাপড়ের কাজ না সাথে শোলা, এই নিয়েই আলোচনা হত। খুব বেশি হলে বাইরে একটু বাটামের কাজ, কোনো এক অজানা মন্দিরের ডিজাইন। প্রতিমা সাবেকি, ডাকের সাজে সজ্জিত। লোকাল কুমোর না কুমোরটুলি, বাজেট হিসেবে সেটা ঠিক হত যদিও। হ্যা, ঠাকুরের হাইট একটা বড় ফ্যাক্টর ছিল অবশ্য, আশপাশের পাড়ার সাথে প্রেস্টিজের ব্যাপারে।
পুজোর কেনাকাটা মোটামুটি দু আড়াই মাস আগেই কমপ্লিট, কারণ বাড়িতে সবারই ভিড় ও গুতোগুতি না পসন্দ। কেনাকাটা বলতে হাতিবাগান ও অবধারিত ভাবে সেন মহাশয় এর মিষ্টি। মা ঠাকুমা ওখানেই গ্যারেজ হলেও আমাদের মাঝে মাঝে গোলবাড়িতে পেন্নাম ঠুকে আসার সুযোগ মিলত। আর যদি কোনো কারণে কলেজ স্ট্রিট যাওয়া হল, তাহলে তো পোয়া বারো, দিলখুসা। কবিরাজি কাটলেট সাটিয়ে তারপর প্যারামাউন্ট এর সরবত তো ছিলই। পুজো মার্কেটিং তো নামেই, আসল উৎসাহ খ্যাটনে। কারণ সত্যি বলতে, আমাদের বাড়িতে বাইরে খাওয়ার রেওয়াজ তেমন ছিল না। চৈত্র সেলে নববর্ষের ও দুর্গাপুজোর মার্কেটিং এবং দুর্গাপুজোর কদিন সেই সুযোগ মিলত, তাই।
পুজোর মাস দেড়েক আগে থেকে চালু হত পুরোনো লোহার বন্দুক পরিষ্কারের কাজ। রুপোলি রঙের পরত উঠে গিয়ে কোথাও কোথাও জং বেরিয়ে গেছে। স্প্রিং গেছে টাইট হয়ে। কেরোসিন তেলে চুবিয়ে ও ন্যাকরা দিয়ে ঘষে মেজে ট্রিগার টিপে রেডি করা হত তাকে। একান্তই দেহ রাখলে তবেই নতুন জুটতো কপালে। ক্যাপ ছিল দু রকম, টিপ ক্যাপ মানে সিঙ্গেল পঁচিশটা আর রোল ক্যাপ মানে গোটা তিরিশেক একসাথে। মহালয়ার দিন পাওয়া যেত প্রথম ক্যাপ বাক্স, না না কোনো বড় বাক্স না, দুটো ছোট বাক্স। পুলিশ কে, কি এমন গুলির হিসেব দিতে হয়, তার চাইতে বেশি হিসেব রাখতে হত আমাদের। মহালয়া থেকে চতুর্থী, বরাদ্দ দুটি বাক্স। পঞ্চমী থেকে দশমী অবশ্য একটা ফুল, মানে দশ বাক্স প্রতিদিন। তখন আর পায় কে, সিনেমার হিরো ও আমাদের কাছে বাচ্চা।
ষষ্ঠি থেকে নবমী, চার দিন সন্ধ্যে হলেই বেরিয়ে পড়ো। আগে থেকেই বাজেট ঠিক করে রাখতে হতো, রোল - চাউমিন - ফিশ ফ্রাই / কাটলেট, একেকদিন একেকটা। সন্ধ্যেবেলা সেইটা খেয়েই এক ছুটে প্যান্ডেলে, ইয়া বড় একখানা ব্যাজ পড়ে ভিড় সামলাতে ভলেন্টিয়ার গিরি। কচি বয়সে বড়োদের উপর হম্বি তম্বি করার লাইসেন্স পাওয়ার যে কি মজা, এই কাজটি যে না করেছে, সে কিছুতেই বুঝবে না। মোটামুটি রাত নটা নাগাদ এক বাক্স টিফিন। ঠান্ডাস্য ঠান্ডা কচুরি ও সিঙ্গারা / ভেজিটেবল চপ, সাথে দুটো করে মিষ্টি। আজকালকার দিনে হাতে নিয়ে দেখলেই অ্যাসিডিটি হবে মনে হলেও তখন কিন্তু ওগুলো খেয়েও জীবনে অসুখ করেনি তারপরেও বাড়ি ফিরে ভরপেট ডিনার করেই শান্ত হতো উদর।
এর মধ্যে অবশ্য একটা দিন সকালেও ভাগ্য অতি প্রসন্ন থাকত। এমনিতে ষষ্ঠি থেকে দশমী, সকালে উঠে স্নান করেই প্যান্ডেলে। কিন্তু অষ্টমীর দিন স্পেশাল। সপ্তমীর রাতে টোকেন বানিয়ে রাখতে হত কাগজ কেটে, একই নাম্বার দুটো করে। গড়পড়তা ২৫০-৩০০ পুজো পড়ত। তার সাথে চার পাঁচ ব্যাচ অঞ্জলীর ভিড় সামলানো ও তার ফুল সাপ্লাই। মূল আকর্ষণ ছিল অষ্টমী পুজো শেষ হলেই প্রত্যেক প্যাকেট থেকে একটা দুটো মিষ্টি উঠিয়ে আলাদা করে রাখা (ভালো মিষ্টি হলে অবশ্যই দুটোর বেশি উঠতো)। তারপর তার থেকে পুরোহিত মশাইদের জন্যে একাংশ রেখে শুরু হত মিষ্টি ভোজন।
খারাপ লাগা শুরু হত দশমীর সকাল থেকেই। দর্পণ বিসর্জন হতেই মনটা হু হু করে উঠতো। মাটির হাড়ির জলের মধ্যে ভেসে থাকা আয়নায় মাতৃ মুখ দর্শন ছাড়াও একটা কাজ করতাম। দর্পণ বিসর্জনের জলে হাত ধোয়া। মায়ের কথায় "ওই জলে যে হাত ধোয়, তার হাতের রান্না সুস্বাদু হয়।" (অখাদ্য হয় নি কোনোদিন এটুকু বলতে পারি, বাকি সত্য মিথ্যা জানি না।)
বিকেল থেকে মায়ের বরণের থালা সাজানো চালু হত। তাতে পান মিষ্টি ধান দুর্বা ও সিঁদুরের সাথে জায়গা পেত আমাদের কলম। বই খাতা হাতে নিয়ে মায়ের সাথেই প্যান্ডেলে, সব ঠাকুরের পায়ে ছোয়াতে হবে তো। দুর্গা মায়ের বরণ সেরে আমার মা বাড়ি ফিরে ঠাকুমা, বাবা কে প্রণাম করতেই আমরাও দুই ভাই লাইন দিয়ে প্রণাম। এবং তারপরেই শুভক্ষণ, নারকোল নাড়ু, কুচো নিমকি ও মিষ্টি সহযোগে সন্ধ্যাকালীন জলযোগ।
একাদশী থেকে চালু হত বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিজয়া। পাড়ার মধ্যে মোটামুটি কার বাড়িতে কোনদিন ভালো আইটেম থাকছে, সেই খবর ঠিক ছড়িয়ে যেত। আমার টার্গেট থাকতো ঘুগনি (কিমা দিয়ে হলে তো কথাই নেই) ও বাড়িতে বানানো সিঙ্গারা ভেজিটেবল চপ। লক্ষ্মী পুজোর দিন কয়েক পর অবধি আমাদের এই অত্যাচার চলত, তারপর বাড়িতে বকুনি খেয়ে খান্ত দিতাম।
© সুব্রত চৌধুরী
Comments
Post a Comment