এক রাতের বৃষ্টি - কলকাতা জলমগ্ন।।

জীবনটাকে ঠিক ১৯ বছর রিউইন্ড করে নিন। ১৯৯৯ সাল। খুব সম্ভবত দিনটা ছিল ২৩ শে সেপ্টেম্বর। সকাল থেকে আকাশের মুখ ভার। মাঝে মাঝে এক আধ পশলা বৃষ্টি হচ্ছে। বিকেল থেকে যে বৃষ্টি নামলো, তা আর থামলো না। সন্ধ্যের থেকে বৃষ্টির বেগ বাড়তে শুরু করল, ঝিরঝির থেকে ঝমঝম।
আমাদের এলাকায় এমনিতেই জল জমার ইতিহাস আছে। ভিআইপি রোডের পাশের খাল আসতে আসতে বুজে এসেছিল, ফলে একটু বেশি বৃষ্টি হলেই পাড়ায় জল জমে যেত, তবে ভিতরের দিকে, আমাদের বাড়ির পর থেকে। আমাদের বাড়ির কাছে রাস্তার উপর জল আসতো না তেমন। বাবা - মা - ঠাকুমার কাছে শোনা ১৯৭৮ এর সময় ও বাড়ির উঠোনে জল জমলেও ঘরের মেঝেতে জল ওঠেনি। তখন অবশ্য একতলা ছিল বাড়িটা। ভিআইপি রোডের উপর পাড়ার মুখেই আমাদের ক্লাব, ক্যারাম খেলে রাত্রিবেলা ছাতা মাথায় বাড়ি ফিরতে গিয়েও ভিজে গেলাম। বাড়ি ঢোকার সময় পাড়ার ভিতরের দিকে তাকিয়ে দেখি রাস্তায় জল জমতে শুরু করেছে। আকাশভাঙা বৃষ্টি দেখে তখনই মনে কু ডাক দিল।

বাড়ি ফিরে খেয়েই শুয়ে পড়লাম। কতক্ষন ঘুমিয়েছি জানি না, দরজায় ধাক্কার আওয়াজ। বাবা ডাকছে। রাত সওয়া তিনটে। তাড়াতাড়ি করে দরজা খুলে ডাইনিং হলে আসতেই দেখি সিড়ির আলো জ্বলছে। অত রাতে পাম্প চালিয়ে বাবা দাড়িয়ে আছে।
"নিচে চল। জল বাড়ছে। উপরের ট্যাংক ভরে গেলে পাম্প অফ করে মোটর খুলতে হবে, নয়তো ডুবে যেতে পারে।"
এক দৌড়ে বারান্দায় গিয়ে বাইরেটা দেখলাম। আমাদের বাড়ির সামনেও প্রায় হাঁটু ছুঁইছুঁই জল জমে গেছে। এক ভাবে বৃষ্টি পড়ে চলেছে। টুল বক্স থেকে তিন চারটে পানা, স্ক্রু ড্রাইভার, প্লাস ও টেস্টার নিয়ে নিচে গেলাম, একতলায় সিড়ির নিচে পাম্প। সদর দরজার তলা দিয়ে জল ঢুকছে, ঘরের মেঝেতে না উঠলেও সিড়ির নিচে ইঞ্চি আটেক জল দাড়িয়ে গেছে ততক্ষনে। কোথাও শর্ট আছে কিনা চেক করে যন্ত্রপাতি নিয়ে জলের মধ্যেই হাঁটু গেড়ে বসলাম মোটর খুলতে।

দীর্ঘ দিনের মরচে ধরা নাট বল্টু, খুলতে বেশ টাইম লাগলো। হাঁটু গেড়ে বসে যতক্ষণে মোটর খুললাম, জল কোমরের কাছে চলে এসেছে। ভোর চারটে বাজে প্রায়। বাবাকে শুতে পাঠিয়ে নিজেও শুতে গেলাম। পরদিন একটা চাকরিতে জয়েন করার কথা ছিল, সে যে আর হবে না, বুঝেই গেছিলাম।

ঘুম ভাঙলো সকাল আটটা নাগাদ। বৃষ্টির তেজ অনেকটা কমে এসেছে। বারান্দায় এসে নিজের পাড়া কেই যেন চিনতে পারছি না। আমাদের বাড়ির সামনে রাস্তায় প্রায় কোমর সমান জল, আমি বা আমাদের বাড়ির লোক কোন ছার, কস্মিনকালে শাস্ত্রীবাগানে কেউ দেখেনি। একতলার ঘরে জল। বাড়ির বাইরে বেরোনোর উপায় নেই এমনিতে, কারণ সদর দরজার কাছেও কোমর সমান জল।

বাবা দেখি চিন্তায়। জল নামতে দেরি হলে কি হবে? বাজারহাট? মা বলল, "চিন্তা নেই, খিচুড়ি বসিয়ে দিচ্ছি, আজকের মত মাছ তো রয়েইছে ফ্রিজে।" বাবার প্রশ্ন "কাল কি হবে? যদি বৃষ্টি না থামে?" আমি শেষমেষ মুশকিল আসান। থলি ও টাকা নিয়ে, গেঞ্জি হাফ প্যান্ট পরে রেডি হলাম। দোতলার বারান্দার হাফ গ্রিল টপকে, ঝুলে নামলাম একতলার কার্নিশে। সেখান থেকে লাফিয়ে মিটার ঘরের ছাতে। সেখান থেকে ইলেকট্রিক পোল ধরে পাঁচিল হয়ে ধীরে ধীরে পাশের বাড়ির কোনায় গিয়ে নামলাম, থাই অবধি জল। হাফ প্যান্ট বাঁচিয়ে কোনরকমে সেই জল ঠেলে বাগুইআটি বাজার। একটা ইলিশ মাছ, এক ডজন হাঁসের ডিম, আর আলু পেয়াজ নিয়ে বাড়ির কাছে এলাম, বাড়ির পাঁচিলের উপর দাড়াতে বাবা বারান্দা থেকে দড়ি ফেলে তুলে নিল জিনিসগুলো। আমি উল্টো পথে চললাম ক্লাবে, আড্ডা মারতে।

ক্লাবের সামনে ভিআইপি রোডের মুখে ভিআইপি সুইটস এর সামনে তিন চার জন বন্ধু দাড়িয়ে আছি। বৃষ্টি প্রায় ধরে এসেছে। তখন সামনে দিয়ে প্রায় ৬ ফিট ডিপ একটা হাই ড্রেন ছিল, খোলা। রাস্তার উপরে শুধু কালভার্ট, গাড়ি ও মানুষ যাতায়াতের জন্য। সেই ড্রেন দিয়ে জল যাচ্ছে হু হু করে, যেন কোন ব্যারেজের ফ্লাড গেট খুলে দিয়েছে কেউ।

পাড়ার এক ভদ্রলোক, রোগা পাতলা, ক্লাবের পাশেই বাড়ি, আমাদের দেখে কোমড়ের লুঙ্গির গিট টা টাইট করতে করতে এগিয়ে এলেন।
"কি খাড়ায় খাড়ায় সব গুলতানি মারতাছস। তগো বয়সে এমন বাদলা দিনে আমরা এতক্ষণে মাঠে নাইম্যা পরসি। আর তোরা বৃষ্টির জলে পা টাও ভিজাস না।" লেকচার দিতে দিতে উনি নিজে যে ভিআইপি সুইটস এর সামনে খোলা ড্রেনের ধারে চলে গেছেন, খেয়াল করেননি। অসাবধানতায় ড্রেনের কোনায় পা পড়তেই পা হড়কে সিধা জলে। এবং জলের তোরে হাই ড্রেনে নাকানি চুবানি দশা। আমরা ব্যাপারটা বুঝতে বুঝতেই দেখি উনি স্রোতের সাথে এগিয়ে চলেছেন, সামনে কালভার্ট। চার জনে কালভার্টের অন্য দিকে গিয়ে পজিশন নিলাম। এপাশ দিয়ে বেরিয়ে হাত দুটো তুলতেই খপ করে ধরে তাকে টেনে তোলা হল।

ভদ্রলোকের একটাই আক্ষেপ রয়ে গেছিলো। লুঙ্গির গিট টা ঠিক টাইট করে বাঁধতে পারেননি, ফলত জীবনে ওনাকে কোনোদিন আর লুঙ্গি পরিহিত দেখিনি আমরা।

©সুব্রত  চৌধুরী


Comments

Popular posts from this blog

কার্তিক পুজো ও খাওয়াদাওয়া

তালশাঁস সন্দেশ

পুজো ও বামুন