প্রথম চাকরি।।
প্রথম চাকরি।।
১৯ বছর আগে, ১৯৯৯ সাল। ডিপ্লোমা শেষ, ফাইনাল ইয়ারের রেজাল্ট বেরোয় নি। ফার্স্ট ও সেকেন্ড ইয়ারের রেজাল্ট দিয়েই নানা জায়গায় অ্যাপ্লাই করা চলছে।
তখনও ইন্টারনেট এবং ইমেল এর রমরমা চালু হয় নি। একে তাকে ধরে ও টেলিফোন ডাইরেক্টরি দেখে বিভিন্ন ছোট বড় কোম্পানির ঠিকানা জোগাড় করাটা একটা সুবিশাল কাজ। তারপর হাতে লিখে, খামে ভরে সেই চিঠি পোস্ট করে বসে থাকো, কবে উত্তর আসবে তার আশায়।
বেশিরভাগ কোম্পানি কোনো উত্তর দিত না। কেউ কেউ তো অফিসে ডেকেও ইন্টারভিউ না নিয়েই মুখের উপর না বলে দিত। শেষ অবধি একটি ডিজাইন কনসালট্যান্সি কোম্পানির অফিস থেকে চিঠি এলো। ইন্টারভিউ। যথা সময়ে হাজির হলাম, মালিক ভদ্রলোক রেজাল্টে চোখ বুলিয়ে বললেন "তুমি তো বাবা ফাইনাল ইয়ারের রেজাল্ট বেরোলেই কনডেন্সড বি ই পড়তে চলে যাবে। তোমায় চাকরি দিয়ে কি লাভ হবে বল?"
"না স্যার, আমি কনডেন্সড বি ই পড়বো না। AMIE করব তাই চাকরি ছাড়বো না। ডিজাইনের কাজ শিখতে চাই শুধু।"
"কিন্তু মাইনে বেশি কিছু দিতে পারবো না। সোম থেকে শুক্র অফিস, মানে মাসে ২০ দিন। বাগুইআটি থেকে মল্লিকবাজার এক পিঠের বাস ভাড়া ৬টাকা। তার সাথে হাতখরচ দিন প্রতি ২০ টাকা। সব মিলিয়ে মাস গেলে ৭০০টাকা দেব। চলবে?"
"চলবে স্যার।"
"কোন অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার দিতে পারবো না কিন্তু।"
"চলবে।"
"ঠিক আছে, তাহলে কবে থেকে আসবে?"
"সামনের শুক্রবার থেকে আসবো স্যার?"
"ওকে"
"না স্যার, আমি কনডেন্সড বি ই পড়বো না। AMIE করব তাই চাকরি ছাড়বো না। ডিজাইনের কাজ শিখতে চাই শুধু।"
"কিন্তু মাইনে বেশি কিছু দিতে পারবো না। সোম থেকে শুক্র অফিস, মানে মাসে ২০ দিন। বাগুইআটি থেকে মল্লিকবাজার এক পিঠের বাস ভাড়া ৬টাকা। তার সাথে হাতখরচ দিন প্রতি ২০ টাকা। সব মিলিয়ে মাস গেলে ৭০০টাকা দেব। চলবে?"
"চলবে স্যার।"
"কোন অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার দিতে পারবো না কিন্তু।"
"চলবে।"
"ঠিক আছে, তাহলে কবে থেকে আসবে?"
"সামনের শুক্রবার থেকে আসবো স্যার?"
"ওকে"
খুব সম্ভবত তারিখটা ছিল ২৪ সেপ্টেম্বর। কিন্তু তার আগেরদিন, এক রাতের বৃষ্টি পুরো কলকাতাকে জলমগ্ন করে দেয়। ফলত, সেইদিন আর অফিস জয়েন করা হয় নি। গেলাম তার পরের দিন, মানে সোমবার।
মল্লিকবাজারের কাছে বার্জার হাউসে অফিস। কোন তলায় মনে নেই তবে বেশ উপরের দিকে মনে আছে। পূর্ব দিকের একটা জানলার পাশে একটি ছোট্ট টেবিল ও কাঠের চেয়ার জুটলো। বাগডোগরা এয়ারপোর্টের রেনোভেসান এর কাজ হবে, আগের স্ট্রাকচারাল রুফ-ট্রাস এর লোড চেক করে নতুন ভাবে এক্সট্রা সাপোর্ট এর ডিজাইন করতে হবে। ভদ্রলোক কাজটা দিয়ে বললেন বুঝতে অসুবিধা হলে সিনিয়ার এর সাথে কথা বলে করো, কালকের মধ্যে চাই।
সদ্য পাশ আউট, আই এস কোড থেকে শুরু করে স্টিল টেবিল, ডিজাইন তখন ঠোঠস্থ। তখন হাতে স্কেচ ও হিসাব করেই ডিজাইন করতে হত, কম্পিউটার ছিল না। জানলা দিয়ে মল্লিকবাজার ক্রসিং দেখতে দেখতে মনে মনেই বললাম, এ তো এক্ষুনি নামিয়ে দেব। মাঝে দু বার সেই সিনিয়ার এসে উকি ঝুঁকি মেরে গেল, অগ্রগতি দেখে একবার বলেও ফেলল, ধীরে সুস্থে কর। সবাই লাঞ্চে গেলেও আমার তখন মাথায় ভূত চেপেছে, কাজটা শেষ করেই যাবো। মোটামুটি তিনটে নাগাদ শেষ হতে সিনিয়ার কে গিয়ে বললাম, কমপ্লিট। উনি এমন ভাবে তাকালেন যেন ভূত দেখছেন, বললেন হতেই পারে না। আমি কথা না বাড়িয়ে সিধা মালিকের ঘরে, ওনাকে ডিজাইন ক্যালকুলেশন শিট দিলাম। উনিও অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থেকে ক্যালকুলেশন দেখলেন।
সদ্য পাশ আউট, আই এস কোড থেকে শুরু করে স্টিল টেবিল, ডিজাইন তখন ঠোঠস্থ। তখন হাতে স্কেচ ও হিসাব করেই ডিজাইন করতে হত, কম্পিউটার ছিল না। জানলা দিয়ে মল্লিকবাজার ক্রসিং দেখতে দেখতে মনে মনেই বললাম, এ তো এক্ষুনি নামিয়ে দেব। মাঝে দু বার সেই সিনিয়ার এসে উকি ঝুঁকি মেরে গেল, অগ্রগতি দেখে একবার বলেও ফেলল, ধীরে সুস্থে কর। সবাই লাঞ্চে গেলেও আমার তখন মাথায় ভূত চেপেছে, কাজটা শেষ করেই যাবো। মোটামুটি তিনটে নাগাদ শেষ হতে সিনিয়ার কে গিয়ে বললাম, কমপ্লিট। উনি এমন ভাবে তাকালেন যেন ভূত দেখছেন, বললেন হতেই পারে না। আমি কথা না বাড়িয়ে সিধা মালিকের ঘরে, ওনাকে ডিজাইন ক্যালকুলেশন শিট দিলাম। উনিও অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থেকে ক্যালকুলেশন দেখলেন।
চেক করতে করতে মুখে হাসি দেখেই বুঝলাম আমি উত্তীর্ণ। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, "লাঞ্চ করেছ?"
"না, এই যাবো।"
ক্যালকুলেশন শিট টা হাতে দিয়ে বললেন "লাঞ্চ করে এসে এটা ফেয়ার করে বানিয়ে আনো। আর হ্যা, তুমি যখন এত সুন্দর ডিজাইন করেছ, তুমিই এটার এক্সিকিউসান করবে।"
"মানে? আমি তো স্যার ডিজাইন এর কাজ শেখার জন্যে শুধু হাতখরচ এর টাকায় কাজ করতে রাজি হয়ে ছিলাম, কলকাতার মধ্যে বলে। এই টাকায় বাগডোগরা গিয়ে কি করবো?"
"আরে কিছু হবে না, একটা বড় কোয়ার্টার দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। তিনটে রুম। দুটোতে মাল রাখবে, একটায় তুমি থাকবে। দারওয়ান থাকবে, সেই রান্না করবে, মাস গেলে তাকে তিন শ টাকা দিও। বাকি টাকা কোম্পানি দেবে। আর পনেরো দিনে একবার করে আসবে যাবে, মানে অফিসে আসার সাথে বাড়ি ও ঘুরে যাবে, বাস ভাড়া তো কোম্পানি দেবে। ওখানে তো আর তোমার বাগুইআটির থেকে মল্লিকবাজারে আসা যাওয়ার ভাড়া দিতে হবে না, অসুবিধা কোথায়?"
"আপনি সিরিয়াস?"
"তুমি লাঞ্চ করে আসো, আমি তোমাকে টেলিফোনে এয়ারপোর্টের ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রধানের সঙ্গে কথা বলিয়ে দিচ্ছি। কোনো অসুবিধা হবে না।"
"না, এই যাবো।"
ক্যালকুলেশন শিট টা হাতে দিয়ে বললেন "লাঞ্চ করে এসে এটা ফেয়ার করে বানিয়ে আনো। আর হ্যা, তুমি যখন এত সুন্দর ডিজাইন করেছ, তুমিই এটার এক্সিকিউসান করবে।"
"মানে? আমি তো স্যার ডিজাইন এর কাজ শেখার জন্যে শুধু হাতখরচ এর টাকায় কাজ করতে রাজি হয়ে ছিলাম, কলকাতার মধ্যে বলে। এই টাকায় বাগডোগরা গিয়ে কি করবো?"
"আরে কিছু হবে না, একটা বড় কোয়ার্টার দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। তিনটে রুম। দুটোতে মাল রাখবে, একটায় তুমি থাকবে। দারওয়ান থাকবে, সেই রান্না করবে, মাস গেলে তাকে তিন শ টাকা দিও। বাকি টাকা কোম্পানি দেবে। আর পনেরো দিনে একবার করে আসবে যাবে, মানে অফিসে আসার সাথে বাড়ি ও ঘুরে যাবে, বাস ভাড়া তো কোম্পানি দেবে। ওখানে তো আর তোমার বাগুইআটির থেকে মল্লিকবাজারে আসা যাওয়ার ভাড়া দিতে হবে না, অসুবিধা কোথায়?"
"আপনি সিরিয়াস?"
"তুমি লাঞ্চ করে আসো, আমি তোমাকে টেলিফোনে এয়ারপোর্টের ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রধানের সঙ্গে কথা বলিয়ে দিচ্ছি। কোনো অসুবিধা হবে না।"
বুঝলাম, পাক্কা ব্যবসায়ী মানুষ। সস্তায় পাওয়া ইঞ্জিনিয়ার, দায় দায়িত্ব ছাড়া (অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারই দেননি, পিএফ এর তো বালাই নেই), নিংরে ছাড়বে।
কিন্তু ঝানু ব্যবসায়ীই ও ভুল করে কখনও কখনও। এক পেট খিদে ও এক রাশ চিন্তা মাথায় নিয়ে নিজের টেবিলের কাছে আসতেই মাথায় বিদ্যুতের ঝিলিক খেলে গেল, ঠিক যেন ক্যাপ্টেন স্পার্ক। জানলার বাইরে তাকিয়ে নিচে সিরাজের বোর্ড দেখতে পেলাম ও নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে ডিজাইন ক্যালকুলেশন শিট। চটপট নিজের পেন ও নোটবুক বুকপকেটে ঢুকিয়ে ও ক্যালকুলেশন শিট প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে সিধা সিরাজ। এক প্লেট মটন বিরিয়ানী খেয়ে, দু খানা বিশালাকার ঢেঁকুর তুলে বাইরে এসে, বার্জার হাউস টাকে ভালো করে দেখলাম।
বিরিয়ানির ঘ্রাণ ও ঢেঁকুরের শব্দ মিলে, একটা দৈববাণী ভেসে এলো যেন - "নিকুচি করেছে এমন চাকরির।" ডিজাইন ক্যালকুলেশন শিট কুচি কুচি করে ছিড়ে হাওয়ায় উড়িয়ে জীবনের প্রথম ও স্বল্পমেয়াদি চাকরিতে ইতি টেনে বাড়ির রাস্তা ধরলাম।
বিরিয়ানির ঘ্রাণ ও ঢেঁকুরের শব্দ মিলে, একটা দৈববাণী ভেসে এলো যেন - "নিকুচি করেছে এমন চাকরির।" ডিজাইন ক্যালকুলেশন শিট কুচি কুচি করে ছিড়ে হাওয়ায় উড়িয়ে জীবনের প্রথম ও স্বল্পমেয়াদি চাকরিতে ইতি টেনে বাড়ির রাস্তা ধরলাম।
© সুব্রত চৌধুরী
Comments
Post a Comment