পালং পনির
আমাদের মধ্যবিত্ত বাঙালি ঘরে তখনও পনিরের প্রবেশ ঠিক ঘটেনি। কারণ না ছিল এত টিভি চ্যানেল, না ছিল বাঙালি সংস্কৃতির উপর হিন্দ বলয় এর গ্রাস। তখন ছানাই ছিল, রান্নাতেও। ছানার ডালনা, ছানার কোপ্তার রসা। আমাদের বাড়িতে মুরগির মাংস থেকে পিয়াজ রসুন সবই ছিল ব্রাত্য। ডিম বলতেও হাঁসের ডিম শুধু। খাসির মাংস রান্না হত হিং ফোড়ন দিয়ে।
গোল বাঁধলো বড় ছেলের মাছ না খাওয়ার জন্যে। মাছ না খেলে ডিম, কিন্তু ডাক্তার রেগুলার হাঁসের ডিম মানা করলেন। ফলে, সদর দরজার চৌকাঠে "চাল পূর্ণ কলস উল্টে" প্রবেশ করল মুরগির ডিম ও তার দোসর পিয়াজ। যদিও জায়গা হল কয়লার ড্রামের পাশে, সিড়ির তলায়। ধীরে ধীরে দোসর টি খাসির মাংসে ও পেয়াজি বা স্যালাডে নিজের জায়গা করে নিতে পারলেও বাকি কোন রান্নায় তার প্রবেশাধিকার ছিল না। কয়লার উনুনের জায়গায় গ্যাস, টিউবওয়েল থেকে জল তুলে ভরা চৌবাচ্চার জলের বদলে পাম্প করে ট্যাংকে তোলা জল, ওয়াশিং মেশিন, এসবের সাথে সাথে পেঁয়াজ ও ডিম রান্নাঘরে স্থান পেলেও মুরগির মাংস ও রসুন আমাদের বাড়িতে প্রবেশাধিকার পায়নি নব্বই এর দশকের মাঝামাঝি অবধি।
এহেন সময় (নব্বই দশকের মাঝামাঝি) একদিন বাবা এসে বাড়িতে বললেন, "আজ অফিসে "পালং পনির" খেলাম।" পদটির রসনা ও স্বাদের প্রতি বাবার প্রশংসায় ধীরে ধীরে বোঝা গেল যে ছানার টুকরো পালং শাক দিয়ে রান্না করা। মা সব শুনে বললেন "পালং শাক কুমড়ো দিয়েই ভালো লাগে।"
কিন্তু আমরা দু ভাই নাছোড়বান্দা। বাবা যা ডেসক্রিপশন দিয়েছে, তাতে না খেলে তো জীবন বৃথা। পালং শাক একদম মাখো মাখো হয়ে যাবে, সাথে ছানার টুকরো।
এক রবিবার বাড়িতে দূধ কেটে তাকে অল্প ময়দা দিয়ে মেখে টুকরো টুকরো করে কাটা হল। এলো পালং শাক। রান্নাঘরে শুরু হল মায়ের সংগ্রাম। দুপুরে খেতে বসে পাতে এলো এক অদ্ভুত জিনিস। ফ্যাটফ্যাটে সবুজ (অনেকটা যেন থানকুনি পাতা বাটা) একটা গ্রেভির মধ্যে থেকে উকি মারছে কিছু ছানার টুকরো। মুখে দিতেই বিস্ফোরণ। এতো পুরো ঘাস ঘাস গন্ধ!!! এ কে খাবে?? দুই ভাই কোনোমতে ছানার টুকরো কটা মুখে পুরে ও মাংস দিয়ে ভাত খেয়ে উঠতেই শুরু হল দু পক্ষের চাপানউতোর।
"আগেই বলেছিলাম, পালং শাক কুমড়ো দিয়েই হয় ভার্সেস তুমি রাঁধতে পারোনি ঠিক করে।"
বলা বাহুল্য, এর পর আর এই পদটি আমাদের বাড়িতে রান্না হয়নি।
গঙ্গা দিয়ে এরপর বহু জল বয়ে গেছে। ছানা হয়েছে পনির। বিয়ের পর আমি ও মহারানী তখন সংসার পেতেছি জামশেদপুরে। একদিন মহারানী বললেন, "একটু পালং শাক, পনির, মাখন ও ক্রিম এনে দেবে? পালং পনির বানাবো।" আমি পূর্ব অভিজ্ঞতার দরুন আঁৎকে উঠলাম। "তুমি শাহী পনির, মটর পনির, পটল পনির (আগের দিনের দুটো তরকারির বেঁচে যাওয়া অংশ একসাথে মিশিয়ে পরেরদিন চালিয়ে দেওয়া) যা খুশি বানাও, কিন্তু প্লিজ পালং পনির না।" গোলমাল সিনেমায় উৎপল দত্ত যে ভাবে পুলিশ অফিসারকে "জুরওয়া" শব্দ শুনে বলেছিলেন, আমার অবস্থাও তথৈবচ। যত জিজ্ঞেসা করে "কেন?" আমার একটাই উত্তর "ঘাসের মত গন্ধ হয়।"
রাত্রে অফিস থেকে বাড়ি ফিরতেই ঘরে একটা সুন্দর গন্ধ পেলাম। ঘ্রানেন্দ্রিয় বলল, অতীব সুস্বাদু কিছু একটা হইয়াছে। কি সেটা, তা অবশ্য কিছুতেই বলে না মহারানী। রাত্রে খেতে বসে ভাতের সাথে থালার পাশে দেখি একটি কালচে সবুজ পদ, গন্ধটাও তার থেকেই আসছে। কি জিজ্ঞেস করতে উত্তর পেলাম - "খেতে বসেছো খাও না, অত কথার কি আছে?" মুখে দিতেই, আহা কি স্বাদ। আরেকটু দিতে বলতেই - "ওটা কিন্তু পালং পনির।"
জীবনে অত বড় হা কোনোদিন করিনি মনে হয়।
©সুব্রত চৌধুরী
গোল বাঁধলো বড় ছেলের মাছ না খাওয়ার জন্যে। মাছ না খেলে ডিম, কিন্তু ডাক্তার রেগুলার হাঁসের ডিম মানা করলেন। ফলে, সদর দরজার চৌকাঠে "চাল পূর্ণ কলস উল্টে" প্রবেশ করল মুরগির ডিম ও তার দোসর পিয়াজ। যদিও জায়গা হল কয়লার ড্রামের পাশে, সিড়ির তলায়। ধীরে ধীরে দোসর টি খাসির মাংসে ও পেয়াজি বা স্যালাডে নিজের জায়গা করে নিতে পারলেও বাকি কোন রান্নায় তার প্রবেশাধিকার ছিল না। কয়লার উনুনের জায়গায় গ্যাস, টিউবওয়েল থেকে জল তুলে ভরা চৌবাচ্চার জলের বদলে পাম্প করে ট্যাংকে তোলা জল, ওয়াশিং মেশিন, এসবের সাথে সাথে পেঁয়াজ ও ডিম রান্নাঘরে স্থান পেলেও মুরগির মাংস ও রসুন আমাদের বাড়িতে প্রবেশাধিকার পায়নি নব্বই এর দশকের মাঝামাঝি অবধি।
এহেন সময় (নব্বই দশকের মাঝামাঝি) একদিন বাবা এসে বাড়িতে বললেন, "আজ অফিসে "পালং পনির" খেলাম।" পদটির রসনা ও স্বাদের প্রতি বাবার প্রশংসায় ধীরে ধীরে বোঝা গেল যে ছানার টুকরো পালং শাক দিয়ে রান্না করা। মা সব শুনে বললেন "পালং শাক কুমড়ো দিয়েই ভালো লাগে।"
কিন্তু আমরা দু ভাই নাছোড়বান্দা। বাবা যা ডেসক্রিপশন দিয়েছে, তাতে না খেলে তো জীবন বৃথা। পালং শাক একদম মাখো মাখো হয়ে যাবে, সাথে ছানার টুকরো।
এক রবিবার বাড়িতে দূধ কেটে তাকে অল্প ময়দা দিয়ে মেখে টুকরো টুকরো করে কাটা হল। এলো পালং শাক। রান্নাঘরে শুরু হল মায়ের সংগ্রাম। দুপুরে খেতে বসে পাতে এলো এক অদ্ভুত জিনিস। ফ্যাটফ্যাটে সবুজ (অনেকটা যেন থানকুনি পাতা বাটা) একটা গ্রেভির মধ্যে থেকে উকি মারছে কিছু ছানার টুকরো। মুখে দিতেই বিস্ফোরণ। এতো পুরো ঘাস ঘাস গন্ধ!!! এ কে খাবে?? দুই ভাই কোনোমতে ছানার টুকরো কটা মুখে পুরে ও মাংস দিয়ে ভাত খেয়ে উঠতেই শুরু হল দু পক্ষের চাপানউতোর।
"আগেই বলেছিলাম, পালং শাক কুমড়ো দিয়েই হয় ভার্সেস তুমি রাঁধতে পারোনি ঠিক করে।"
বলা বাহুল্য, এর পর আর এই পদটি আমাদের বাড়িতে রান্না হয়নি।
গঙ্গা দিয়ে এরপর বহু জল বয়ে গেছে। ছানা হয়েছে পনির। বিয়ের পর আমি ও মহারানী তখন সংসার পেতেছি জামশেদপুরে। একদিন মহারানী বললেন, "একটু পালং শাক, পনির, মাখন ও ক্রিম এনে দেবে? পালং পনির বানাবো।" আমি পূর্ব অভিজ্ঞতার দরুন আঁৎকে উঠলাম। "তুমি শাহী পনির, মটর পনির, পটল পনির (আগের দিনের দুটো তরকারির বেঁচে যাওয়া অংশ একসাথে মিশিয়ে পরেরদিন চালিয়ে দেওয়া) যা খুশি বানাও, কিন্তু প্লিজ পালং পনির না।" গোলমাল সিনেমায় উৎপল দত্ত যে ভাবে পুলিশ অফিসারকে "জুরওয়া" শব্দ শুনে বলেছিলেন, আমার অবস্থাও তথৈবচ। যত জিজ্ঞেসা করে "কেন?" আমার একটাই উত্তর "ঘাসের মত গন্ধ হয়।"
রাত্রে অফিস থেকে বাড়ি ফিরতেই ঘরে একটা সুন্দর গন্ধ পেলাম। ঘ্রানেন্দ্রিয় বলল, অতীব সুস্বাদু কিছু একটা হইয়াছে। কি সেটা, তা অবশ্য কিছুতেই বলে না মহারানী। রাত্রে খেতে বসে ভাতের সাথে থালার পাশে দেখি একটি কালচে সবুজ পদ, গন্ধটাও তার থেকেই আসছে। কি জিজ্ঞেস করতে উত্তর পেলাম - "খেতে বসেছো খাও না, অত কথার কি আছে?" মুখে দিতেই, আহা কি স্বাদ। আরেকটু দিতে বলতেই - "ওটা কিন্তু পালং পনির।"
জীবনে অত বড় হা কোনোদিন করিনি মনে হয়।
©সুব্রত চৌধুরী
Comments
Post a Comment