কড়াইয়ে মাখা ভাত
"আমি রুটি পাউরুটি কিচ্ছু খাবো না মা।"
"তো কি খাবি?"
"ভাত, মাছু দিয়ে।"
"মাছ দিয়ে ভাত, দুপুরে আর রাত্তিরে বাবা। এখন ঘী দিয়ে একটু ভাত মেখে দিচ্ছি, খেয়ে নে। লক্ষ্মী সোনা।"
"নাআআআআআ"
সকালের স্কুল, প্রাইমারি ক্লাস। বাড়ি ফিরতাম দশটা সোয়া দশটায়। এবং রোজকার বায়ানাক্কা।
"তো কি খাবি?"
"ভাত, মাছু দিয়ে।"
"মাছ দিয়ে ভাত, দুপুরে আর রাত্তিরে বাবা। এখন ঘী দিয়ে একটু ভাত মেখে দিচ্ছি, খেয়ে নে। লক্ষ্মী সোনা।"
"নাআআআআআ"
সকালের স্কুল, প্রাইমারি ক্লাস। বাড়ি ফিরতাম দশটা সোয়া দশটায়। এবং রোজকার বায়ানাক্কা।
তখনও গ্যাস আসেনি বাড়িতে। মাটির উনুনে কয়লা ও ঘুটে দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে রান্না হত। ভোরবেলা আমি স্কুলে চলে যেতাম। বাবা সকাল সকাল বাজার করে ফিরতেন। বাবার অফিস ও দাদার স্কুল, দুজনেই ভাত খেয়ে সকাল সোয়া নয়টায় বেরোত। দাদাকে স্কুল বাসে তুলে দিয়ে বাবা অফিসের জন্যে বাস ধরতেন। তার মধ্যে ভাত, ডাল, ভাজা, দু রকম তরকারি (দাদা মাছ খেতো না), মাছের ঝোল ও দুজনের টিফিন ঠিক বানিয়ে দিতেন মা। অতি ছোট বয়সে বাড়ির পাশে সকালের স্কুলে আমার দাখিলা করানোর অন্যতম কারণ ছিল নির্বিঘ্নে যাতে ওই সময়ে সব গুছিয়ে ফেলা যায়।
মধ্যবিত্তের সংসারে গোনা গুনতি মাছ আসতো। তাই স্কুল থেকে ফিরে আমার এহেন বায়নক্কা র ঝড় সামলানো মায়ের পক্ষে একটু কঠিনই ছিল। কোনোদিন মাছের কাটা কুটো বা হয়তো মায়ের নিজের মাছের টুকরো থেকেই কিছুটা দিয়ে আমার ক্ষুধা ও জেদ মেটাতে হত।
আমার এহেন ভোজনের ঠেলায় বাড়িতে সকালের জলখাবারের আলাদা পাট লাটে উঠলো ধীরে ধীরে। বড় ছেলে মাছ খায় না, এদিকে ছোটো টি যখন মাছের এত ভক্ত, তখন ধীরে ধীরে সকালের আর এক পিস মাছ ও বরাদ্দ হয়ে গেল। মা, আমায় খাইয়ে জলখাবার এ নিজেও ভাত খেয়ে নিতেন।
একদিন, আমার খাওয়ার পর, রান্না ঘরে গিয়ে দেখি মা ভাত খাচ্ছেন। কড়াইয়ের মধ্যে মাখা বেশ লাল লাল ভাত টা।
"ওটা কি?"
"মাছের ঝোলের কড়াইয়ে মাখা ভাত।"
"আমায় দাও না একটু।"
"কাঁচা লঙ্কা দিয়ে মাখা, ঝাল লাগবে।"
"দাও না, দাও না, দাও না"
"ওটা কি?"
"মাছের ঝোলের কড়াইয়ে মাখা ভাত।"
"আমায় দাও না একটু।"
"কাঁচা লঙ্কা দিয়ে মাখা, ঝাল লাগবে।"
"দাও না, দাও না, দাও না"
ব্যাস, বাকিটা ইতিহাস। গরম মাছের ঝোলের কড়াই থেকে দুপুরের ও রাত্তিরের বাসনে খাবার ঢেলে রাখার পর, কড়াইয়ের গায়ে লেগে থাকা ঝোল ও মশলার সাথে কাঁচা লঙ্কা ও নুন দিয়ে ভাত মেখে যে খেয়েছে, সেই জানে এর স্বাদ। স্কুল থেকে ফিরে মায়ের সাথে রান্নাঘরে পিড়িতে বসে কড়াইয়ে মাখা ভাত আমার বাঁধাধরা জলখাবার ছিল। বড় স্কুলে যাওয়ার পর অবশ্য শনিবার ও সপ্তাহের মাঝে কোনো ছুটি থাকলেই জুটতো (কারণ রবিবার তো লুচি আর পরে একটুকরো মাংস দিয়েই একটু ভাত)।
আজ রান্নার পর খালি কড়াইয়ের দিকে তাকিয়ে বড়ই নস্টালজিক হয়ে গেলাম। পারলাম না লোভ সামলাতে, এক হাতা ভাত, একটা কাঁচা লঙ্কা ও নুন দিয়ে মেখেই ফেললাম কিছুটা। মায়ের হাতের মাখা সেই স্বাদ না এলেও, চোখের কোণ টা চিক চিক করে উঠল।
©সুব্রত চৌধুরী
Comments
Post a Comment