ইঁদুর দৌড় - পর্ব ১


খড়গপুর থেকে ট্রেন চলে গেছে বহুদিন। সুদীপ কিছুকাল অপেক্ষা করলেও, বন্ধ দরজা আর খোলেনি। সেকেন্ড ইয়ার অবধি মৌমিতার থেকে টুকটাক খবর পেলেও সুদীপ বুঝে গেছিল দরজা চিরতরে বন্ধই হয়ে গেছে।
"ইঁদুর দৌড়ে সামিল না হয়ে বোধহয় ভুলই করে ফেলেছি।" - নিজের দাদাকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেই মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির চাকরি জয়েন করতে দেখে একটু হতাশ হয়ে পড়ে সুদীপ। বাড়িতে মা - বাবা বা আত্মীয়স্বজন সকলেই ঠারে ঠারে যেন বুঝিয়ে যায়, সে মস্ত বোকা। পড়াশোনায় ভাটা না পড়লেও, প্রাণোচ্ছল ছেলেটা আস্তে আস্তে যেন হারিয়ে যেতে থাকে।
ব্যাপারটা নজর এড়ায় না মালিনীর। মালিনী মন্ডল, ২৮ বছর বয়স, অর্গানিক কেমিস্ট্রির অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর। গত বছর জয়েন করেছেন কলেজে। কলেজের প্রথম ক্লাস ছিল সুদীপ দের ক্লাসেই। এবং ছাত্র ছাত্রীরাই উল্টে তার ক্লাস নিয়ে নিয়েছিল সেদিন। অগ্রণী ভূমিকায় ছিল সুদীপ, তার বুদ্ধিদীপ্ত প্রশ্নবাণ নিয়ে। পরবর্তী পর্যায়ে শক্ত হাতে পড়ানোর সুনাম কুড়িয়েছেন যদিও, কিন্তু সুদীপকে মনে রেখেছিলেন ঠিক।
কলকাতা ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল চালু হলেই সুদীপের মাথার ক্যারা পোকাটা একটু নড়ে ওঠে। ক্লাস কামাই করে হলেও বেশ কিছু ভালো সিনেমা দেখা চাই। সেদিন নন্দন থেকে ফিরছিল মেট্রোতে, দুপুরের ফাকা মেট্রো। মহাত্মা গান্ধী রোড থেকে মালিনী উঠেই দেখতে পেলো সুদীপ বসে আছে কোনার দিকে। তিনজনের সিটে একা। পাশে বসতেই চোখ তুলে তাকালো সুদীপ - "ম্যাম!! আপনি?"
"বসো বসো, আমি বাঘ ভাল্লুক না, বা কোনো কেউকেটা নই, যে পাশে বসতে পারবে না।"
পড়াশোনা নিয়ে কথা চলল বেশ কিছুক্ষণ। দমদমে নেমে মালিনী জিজ্ঞেস করল "বাড়ি কোথায়?" "নগেরবাজার, দেবী নিবাস। আপনার?"
"চলো, এক অটোতেই যাওয়া যাক। মতিঝিলের ওখানে নতুন ফ্ল্যাট কিনেছেন বাবা, আগে বিরাটিতে থাকতাম আমরা।"
"চলুন। আপনি মেট্রোতে যাতায়াত করেন?"
"অর্ধেকটা। সকালে বাসে যাই, স্ট্যান্ড থেকে উঠলে সিট পাওয়া যায়। বিকেলে মেট্রো।"
অটোতে বসে মালিনী ভাবে সুদীপকে হাসিখুশি ভাবটা উধাও হবার কারণ জিজ্ঞেস করবে কিনা। যদি কিছু মনে করে, থাক। তার চাইতে অনার্সের পড়া নিয়ে কথা বলাই ভালো। ছেলেটা নিজের পড়ার দিকে একশো শতাংশ ফোকাস করলে বহুদূর যাবে।
মাঝে মধ্যে কলেজে বা রাস্তায় দেখা হলে দুজনেই হাসি ও কুশল বিনিময় করত। মাঝে মধ্যে মেট্রোয় ফিরত একসাথে। একদিন সাহস করে মালিনী জিজ্ঞেস করে ফেললো কথাটা।
"ব্যাপার কি বলত? দিন দিন কেমন যেন হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ছো মনে হচ্ছে?"
"না, তেমন কিছু না।"
"বলেই দেখো। কিছুটা হালকা তো হবে।"
"ইঁদুর দৌড়ে বোধহয় হেরে গেছি আমি" - একটু একটু করে পুরো ঘটনাটাই খুলে বলে মালিনীকে।
কথাগুলো শুনে ক্ষণিক নিশ্চুপ হয়ে যায় মালিনী। অটোতে উঠে ভরসা দেয় সুদীপ কে। "আমাকে দেখো, কেমিস্ট্রি নিয়েই পড়েছি, পিএইচডি করে আজ স্বাবলম্বী। তুমিও পারবে, পড়াশোনার ওপর ফোকাস করো।"
ফার্স্ট ক্লাস নিয়েই অনার্স পাশ করে সুদীপ। মালিনীর মোরাল সাপোর্ট ও স্পেশাল নোটস এর অবদান অনস্বীকার্য। বন্ধু বান্ধব বা মালিনী ফার্স্ট ক্লাস পাওয়ার খবরে খুশি হলেও বাড়িতে কারোর খুব একটা উচ্ছাস চোখে পড়ে না। বাবা জিজ্ঞেস করল শুধু - "এবার কি মাস্টার্স করবে, না চাকরির পরীক্ষায় বসবে? তোমার দাদা তো উচ্চমাধ্যমিকের চার বছর পরেই চাকরি পেয়ে গেছিল।"
কি বলবে, ভেবে পায় না সুদীপ। এম এস সি র জন্য ভর্তি হয়েও জিপিও র সামনে থেকে রেলের পরীক্ষার ফর্ম তোলে সে। ব্যাপারটা জানতে পেরে এক রকম রাগারাগি করেই ফর্মটা ছিড়ে ফেলে দেয় মালিনী। একটা প্রতিভা এই ভাবে নষ্ট হয়ে যাবে, কিছুতেই মানতে পারে না সে। যে ছেলেটাকে ইঁদুর দৌড়ে র হতাশা থেকে বের করে এনেছিল, সে আবার একই ঘূর্ণাবর্তে পড়েছে। না, এ হতে পারে না। কিছুতেই হতে দেবে না। নিজের অজান্তেই কখন যেন ভালোবেসে ফেলেছে সুদীপ কে। মালিনী যে ওর প্রতি দূর্বল, সুদীপ বোঝে সেটা। কিন্তু ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ডরায়।
সুদীপ বাড়িতে পরীক্ষার ফর্ম পূরণ না করার কথা চেপে যায়। কি হবে ফালতু ঝামেলা করে। কিন্তু পাশের বাড়ির মানসদার পরীক্ষার অ্যাডমিট কার্ড আসতেই ফাঁস হয়ে যায় ব্যাপারটা। মা বাবা দুজনেই একটু ক্ষুব্ধ হয়। দাদা ইনক্রিমেন্ট এর খুশিতে বিরিয়ানী নিয়ে এসেছিল রবিবার দুপুরে। খাবার টেবিলে একসাথে খেতে বসে সুদীপের বাবা বললেন -
"দাদার চাকরি ও বাবার পেনশনের টাকায় আর কতদিন। নিজের দাদাকে দেখে শেখো, কি ভাবে ক্যারিয়ার গঠন করতে হয়।"
জীবনে প্রথম বার পুরো বিরিয়ানী না খেয়ে পাতে ফেলেই উঠে গেলো সুদীপ।।
©সুব্রত চৌধুরী



Comments

Popular posts from this blog

কার্তিক পুজো ও খাওয়াদাওয়া

পুজো ও বামুন

তালশাঁস সন্দেশ