ইঁদুর দৌড় - শেষ পর্ব


ধীরে ধীরে গঞ্জনা গুলো গা সওয়া হয়ে যায় সুদীপের। ইউনিভার্সিটির ক্লাস শেষে অনেকক্ষন সময় কমন রুমে - ইউনিয়ন রুমে কাটিয়ে বা মালিনীর সাথে কফি হাউসে বসে গল্প করে তবে বাড়ি ফিরত সুদীপ। দুটো টিউশন ও নিয়েছে হাতখরচ চালানোর জন্যে, সপ্তাহে চারদিন তাই একেবারে খাওয়ার সময় বাড়ি ফেরা।
মালিনী আর সুদীপ কে একসাথে দেখে অনেকেই ফিসফাস করত। একদিন কমন রুমে বরুণ বলেই ফেলল মুখের উপর। "ভাই, তোর ক্যালি আছে মানতে হবে। আমাদের কাল ঘাম ছুটে গেল ক্লাসের বা জুনিয়ার মেয়েগুলোকে পটাতে, আর তুই কিনা প্রফেসরকে নিয়ে ফষ্টি নষ্টি করে বেরাচ্ছিস।" এক ঘুষিতে বরুণের চোয়াল ঘুরিয়ে দিয়েছিল সুদীপ। অবশ্য বরুণ ও পাল্টা হাত চালায়। বাকিরা মিলে অনেক কষ্টে ছাড়ায় দুজনকে। পরন্ত বিকেলে কফি হাউসে সুদীপের মুখ চোখ দেখেই মালিনী বুঝতে পারে কিছু একটা গন্ডগোল হয়েছে।
"কি হয়েছে?"
"তুমি বিয়ে করবে না?"
"মানে? কি? বলবে কি হয়েছে?"
মাথা নিচু করে কমন রুমের কথাগুলো বলে সুদীপ, তাকায় মালিনীর দিকে। ভাবান্তর চোখে পড়ে না কিছু। একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে মালিনীর প্রতি।
"শুধু দুটো লিকার চা বলি? তোমার মুখ দেখেই বুঝতে পারছি, আর কিছু খাবে না, তাই তো?"
"তুমি কিছু বলবে না?"
"কাকে? জনে জনে ডেকে কি বলব? সত্যিই তো আমি তোমাকে ভালোবাসি। তুমিও আমাকে ভালোবাসো, আমি জানি। বাড়ি থেকে বিয়ের কথা বলেছিল বাবা মা, আমি না করে দিয়েছি। তবে এবার ভাবছি তোমার কথাটা বলে দেব।"
"আমার নিজেরই চাল চুলো নেই বলতে গেলে, এম এস সি কমপ্লিট হতে এখনো বছর খানেক, আমরা বিয়ে করব?"
"কেন? তুমি পুরুষ, তায় বেকার, এদিকে চাকুরীরতা বউ, বয়সে বড়, তাই? লোক সমাজের ভয়, নাকি বাড়ির? নাকি তোমরা ব্রাহ্মণ, আমি মন্ডল? কোনটা?" বলে মুচকি মুচকি হাসতে লাগলো মালিনী।
"এর মধ্যে ব্রাহ্মণত্ব আসলো কোথা থেকে? এখনই যদি বিয়ে করি, তাহলে ইঁদুর দৌড়ে হেরে গেছি বলেই ভাববে সবাই। সেটা ভালো লাগবে?"
"বিয়ে করলেই পড়াশোনা বন্ধ করে দিতে হবে, এমন কথা কে বলল? তুমি চাকরির কথা ভাবছো তো? আমরা তো কালকেই বিয়ে করছি না। হ্যা, মাস্টার্স কমপ্লিট করে, তারপর। অবশ্য আমিই একতরফা বলে চলেছি, তোমার আদৌ মত আছে কিনা সেটা তো বলো।"
"আমি কি না বলেছি? সামনের মাসে দাদার বিয়ে, অনুষ্ঠানটা মিটে গেলে বাড়িতে কথা বলব। তবে একটা কথা বলি নি। আমি সিভিল সার্ভিসের প্রিপারেশান নিচ্ছি।"
দুটো ব্ল্যাক টী শেষ করে উঠে পরে দুজনে।



দাদার বিয়ের পর মা কে মালিনীর কথা বলে সুদীপ।
"বয়সে বড়, তাও প্রায় ৮ বছর, তাকে বিয়ে করবি? নিজের মুরোদ তো দুটো টিউশনি করে হাজার বারোশো টাকা। মেয়েটার মাইনের টাকায় খাবি? যত সব আদিখ্যেতা। মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে মাথাটা খেয়েছে তোর। বাবা জানলে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেবে।"
ঠিক যেন চার বছর আগের কথাগুলো ফিরে এলো, শুধু সে উল্টোদিকে এবার। না, এ হতে পারে না।
"কিন্তু মা......."
"ব্যাস, অনেক হয়েছে। তায় আবার মন্ডল। আমাদের বাড়িতে এসে ঠাকুর ঘরে যাবে, পুজোর ভোগ রাঁধবে? তোর দাদু দিদা ঠাকুরদা ঠাকুমা কোনোদিন ব্রাহ্মন ছাড়া কারোর হাতে জল খায়নি, আর শেষে কিনা তুই..... ছিঃ।"
সুদীপ হাসবে না কাঁদবে ভেবে পায় না। মা কে বলে "দিদা শেষ সময় যখন হাসপাতালে ছিল, তখন আয়া বা নার্স কি ব্রাহ্মন ছিল? মেজ জেঠুর মেয়ে জবা দি কায়স্থ ছেলেকে বিয়ে করেছিল বলে তোমরা ওকে আর ভোগ ছুঁতে দাও না। গোত্রান্তর হয়ে গিয়ে দিদি নাকি এখন কায়স্থ। তাহলে সেই যুক্তিতেই মালিনী গোত্রান্তর হয়ে এবাড়িতে এলে ও কেন ব্রাহ্মন হবে না?"
"সব প্রশ্নের উত্তর হয় না। এখন খেতে বসে উদ্ধার কর আমায়।"
পরদিন সকাল হতেই আরেক প্রস্ত ঝড় চালু হল। "নষ্টামি করতে হয় তো এবাড়িতে হবে না। নিজের রাস্তা নিজে দেখো।" শেষ কথাটা সুদীপ কে বলেই সুদর্শন বাবু বেরিয়ে গেলেন।
কয়েকদিন ধরে কেউ আর বাড়িতে সুদীপের সাথে কথা বলে না। নিজের বাড়িতে যেন অনাহুত আগন্তুক হয়ে থাকে। ইচ্ছে করেই বেশি রাত করে বাড়ি ফেরে। টেবিলে খাবার চাপা দেওয়া থাকে, খেয়েই নিজের ঘরে চলে যায়। রাত জেগে চোয়াল চেপে সিভিল সার্ভিসের জন্যে তৈরি হতে থাকে। মালিনীর কাছে ব্যাপারটা চেপে গেছিল, কিন্তু শেষমেষ বলতেই হল।
"তোমার নিজের কি মত শুনি? পারবে আমার হাত ধরতে?"
"পারবো।"
"আমি বাড়িতে কথা বলছি, ওখানেও মনে হয় না মানবে। তবে আমরা একটা ভাড়া বাড়ি আফোর্ড করতেই পারি। কি বল?"
মাস দুয়েক বাদে দুজনেই ঘর ছাড়ে একসাথে। শহরের উপকন্ঠে একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছিল আগেই। সেটা পেতেও কম হ্যাপা পোহাতে হয়নি। কাছের পাঁচ সাত জন বন্ধু বান্ধবীকে নিয়ে রেজিস্ট্রি ম্যারেজ করে বাঁধে নিজেদের বাসা। বিয়ের দুদিন বাদে দুজনে মিলে বন্ধুদের সবাইকে বাড়িতে বানিয়ে খাইয়েছিল মটন বিরিয়ানী।
সময় বয়ে যায়। দু বাড়িতেই নিজেদের ছেলে মেয়ের আসায় নিষেধাজ্ঞা না থাকলেও তাদের প্রিয়জনের উপর অলিখিত নিষেধাজ্ঞা ছিল। সুদীপ সম্পর্ক রাখবে নাই ভেবেছিল, কিন্তু মালিনী বোঝায়, "সপ্তাহে একদিন, শনিবার বা রবিবার করে দুজনে নিজের নিজের বাড়ি থেকে ঘুরে আসা উচিত। অন্তত কোনোদিন সম্পর্ক চুকিয়ে দেওয়ার দোষ নিজেদের বিবেকের কাছে বইতে হবে না।"
সুদীপের সিভিল সার্ভিসে হয় নি। এম এস সি তে ফার্স্ট ক্লাস নিয়েই পাস করে সুদীপ। আদাজল খেয়ে আবার সিভিল সার্ভিসের জন্যে তৈরি হচ্ছে। তবে সাথে NET ও SET এর জন্যেও প্রস্তুতি চলছে। বাড়িতে সাইন্সের কোচিং ও চালায় সাথে। মালিনীর অনেক পীড়াপিড়িতেও পিএইচডি র দিকে যায়না সুদীপ।
হঠাৎ একদিন মালিনীর বাবা সেরিব্রাল অ্যাটাকে মারা যান। খবর পেয়ে দুজনে পৌঁছানোর আগেই সব শেষ। কোনো কথায় কান না দিয়ে শেষকৃত্যের সমস্ত ব্যাপার সুদীপ নিজেই করে। সমস্ত কাজ মিটলে মালিনী কে বলে মা কে নিজেদের কাছে নিয়ে আসতে। রাজি হন না সাবিত্রী দেবী। সময় চান একটু। কিছুদিনের মধ্যেই পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোতে লাগলো। UPSC, WBCS, NET কোনোটাই হল না এবারও, কিন্তু SET এ চান্স পেয়েছে সুদীপ। পোস্টিং খড়গপুর কলেজে।
আগের ভাড়া বাড়িটা ছেড়ে দিয়ে মতিঝিলের কাছেই একটা ছোট্ট ফ্ল্যাট ভাড়া নিল ওরা। সুদীপই বলল, "তুমি তো এক্ষুনি ওইদিকে ট্রান্সফার নিতে পারবে না। এদিকে মা ও একা, এখানে থাকলে তুমি কাছাকাছি থাকবে। কোনোদিন ক্লাস কম থাকলে চলে এলাম, নয়ত সপ্তাহান্তে তো আমি আসবই, কখন ও তুমি এলে। তারমধ্যে দেখা যাক, কপালে কি লেখা আছে।"
সুদীপের দাদা ইউকে তে চলে গেছে। বউ ছেলে নিয়ে ওখানেই সেটেল্ড। বাড়িতে বাবা মা একা হয়ে গেছে। সুদীপ এলে বাবা মা এখন একটু আধটু কথা বলে তাও। বড় ছেলের উপর অনেকটা নির্ভরশীল ছিলেন, এভাবে একা হয়ে পড়বে, ভাবেননি কখনও। বয়স তো বাড়ছে, বাবার ৭২ মায়ের ৬৭। একদিন মালিনী কে বাড়িতে আনবে কিনা জিজ্ঞেস করেছিল, হ্যা না কিছুই বলেননি তারা।
একদিন রাত্রিবেলা প্রায় সাড়ে এগারোটার সময় বাবার ফোন। "তোর মা কেমন করছে, বুকে ব্যাথা বলছিল, কেমন যেন করছে। এত রাতে কি করব কিছুই বুঝতে পারছি না।"
"আমি দেখছি।"
হিসেব করে দেখে, গাড়ি ভাড়া করে গেলেও অন্তত তিন ঘন্টা। মালিনী কে ফোন করে জানায় সুদীপ। ফোনটা কেটে মিউনিসিপ্যালিটির অ্যাম্বুলেন্সে ফোন করে নিচে দৌড় দেয় মালিনী। নিজের বাবাকে বাঁচাতে পারেনি তখন, এবার সে জিনিস কিছুতেই হতে দেবে না সে। ফ্ল্যাটের একতলায় ডঃ চক্রবর্তী থাকেন, বয়স্ক মানুষ, ওনাকে ডেকে একটা রিকশা নিয়ে পৌঁছায় সুদীপ দের বাড়িতে। ইতিমধ্যে অ্যাম্বুলেন্স এসে গেছে। ডঃ চক্রবর্তী প্রাথমিক ওষুধ দিয়ে বলে "অবস্থা ক্রিটিকাল, ভালো জায়গায় নিয়ে যাও।" অ্যাম্বুলেন্স দৌড়য় সোজা উডল্যান্ডস।
ম্যাসিভ অ্যাটাক ছিল। সময়মত ব্যবস্থা হওয়ায় সে যাত্রায় বিপদমুক্ত হয় দীপিকা দেবী। দশ দিন বাদে বাড়ি ফেরেন, ডাক্তার খুব সাবধানে রাখতে বলেছেন। মালিনী ও সুদীপ বাড়িতে নিয়ে আসে। বাড়ি ঢুকে আয়া সেন্টারে ফোন করে মালিনী দিনে রাতে দুজন আয়ার ব্যবস্থা করে আগে। আয়া এলে তাকে কাজ বুঝিয়ে দিয়ে মালিনী চলে যায়। সুদীপ বাবার হাতটা ধরে শক্ত করে।
বড় ছেলে খবরটা শুনে টাকা পাঠিয়েছে। এক দু দিন ছাড়া ছাড়া ফোন করে খবরও নিয়েছে। সুদীপ ও কাজে যোগ দেয়। শুধু রোজ সকালে ও রাতে মালিনী আসে বাড়িতে, শোয়ার ঘরের বাইরে থেকে আয়াদের জিজ্ঞেস করে ও কাজের ব্যাপারে বলে চলে যায়। সুদর্শন বাবু ও দীপিকা দেবী নিস্পলক চোখে নীরবে তাকিয়ে থাকে। একদিন সুদর্শন বাবু এগিয়ে এসে হাতটা চেপে ধরে মালিনীর।
"আমাদের ক্ষমা করে দাও মা। আমরা তোমায় ভুল বুঝেছিলাম। তুমি রোজ দু বেলা আসো, তবু ঘরে ঢোকো না, বাইরে দাড়িয়ে কথা বল। আমি জানি, আমরা যে ভুল করেছি তার ক্ষমা নেই, তবু পারলে ক্ষমা করে দিও।"
"আপনারা আমায় তো কিছু বলেননি কোনোদিন। আপনারা সুদীপ কে ভুল বুঝেছিলেন।"
"হ্যা, ভুল বুঝেছিলাম। বুঝতে পারিনি ও কি পেয়েছে। ওর দ্বারা জীবনে কিছু হবে, এটাই আমরা ভাবতে পারতাম না। আর ওর দাদাকে দেখ, মায়ের এত বড়ো অসুখ গেল, এত টাকা রোজগার করে, একটিবারের জন্যেও আসতে পারলো না?"
"একটা কথা বলব, বাবা। ছোট মুখে বড় কথা মনে হতে পারে। ক্ষমা করবেন। আপনারা আবারো ভুল করছেন। আসতে চাইলেই কি সে আসতে পারবে? আপনারাই চেয়েছিলেন যে আপনাদের সন্তানেরা যেন হরিপদ কেরানী হয়ে জীবন না কাটায়? জীবনে কেউকেটা হতে হবে, বিশাল চাকরি করতে হবে, সমাজে যাতে মাথা উঁচু করে নিজের সন্তানের পরিচয় দেওয়া যায়, তেমন হতে হবে। সমাজের সাথে সাথে আপনারাও ইঁদুর দৌড়ের কথাটা তাদের মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। আজ সে উচ্চপদস্থ চাকুরীজীবী। মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি গুলো গাড়ি বাড়ি টাকা দিয়ে তাদের স্বত্তাটুকুও কিনে নেয়। বুকে পাথর চেপে দাদাও কাজ করে যাচ্ছেন হয়ত। কারণ, চাইলেই তো কেউ ছুটি দেবে না তাকে, প্রজেক্ট কমপ্লিট করতেই হবে সময়ে।"
"আর লজ্জা দিয়ো না মা। তুমি এই বাড়িতে আসো।এখন থেকে এখানেই থাকো।"
"সে তো হবে না বাবা। মায়ের অসুখের আগেই মালিনী বিদ্যাসাগর ইউনিভার্সিটির প্রফেসর পদে আবেদন করেছিল। চিঠি এসে গেছে। সামনের সপ্তাহে জয়েনিং।" সুদীপ কখন এসেছে খেয়ালই করেননি সুদর্শন বাবু ও মালিনী।
"তার চাইতে আমি একটা কথা বলব, শুনবে?" বেডরুমে ঢুকে মায়ের বিছানার কোনায় বসে বলে সুদীপ। "মেদিনীপুর শহরে একটা ঘর ভাড়া নিতে হবে, ওখান থেকে মালিনীর আসাযাওয়া সুবিধা হবে। একটা বড় দেখে থ্রি বেডরুম ফ্ল্যাট ভাড়া নিচ্ছি। মালিনীর মা, তোমরা সবাই চল ওখানে। একসাথে থাকবে। কোনো অসুবিধা হবে না দেখো। একমাত্র মায়ের যদি মালিনীর হাতের রান্না খেতে অমত না থাকে তো।"
নীরবে দু চোখের পাশ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে দীপিকা দেবীর।
আজ সুদীপ ও মালিনী দুজনে মিলে মটন বিরিয়ানী ও মটন কষা রান্না করেছে দুই মা ও বাবার জন্যে, সবার জন্যে, মেদিনীপুরের ফ্ল্যাটে। সব্বাই চেটেপুটে খেয়েওছে কিন্তু।
© সুব্রত চৌধুরী




Comments

Popular posts from this blog

কার্তিক পুজো ও খাওয়াদাওয়া

তালশাঁস সন্দেশ

পুজো ও বামুন