হাফ ম্যাড না ফুল?
"এখন যেতে পারলে যাও। কিন্তু কাল দুপুর দুটোর মধ্যে যেন সাইটে দেখতে পাই।" কথাটা বলে গোস্বামীদা দূর্গাচকে নিজের ভাড়া বাড়িতে ঢুকে গেলেন।
২২ শে জানুয়ারি ২০০৭। হলদিয়ায় কর্মরত, সিমপ্লেক্স এ। টাটা হুগলি মেট কোক প্রজেক্টের সেকেন্ড ফেসের প্রীকাস্ট পাইলিং এর কাজ। ২৪ তারিখ প্রথম পাইল কাস্ট হবে ও হেড অফিস থেকে অনেক বড় সাহেব আসবেন। CEO ও আসতে পারেন। কিন্তু গোল বেঁধেছে এই যে ২৩ তারিখ সরস্বতী পুজো। এবং পৈতে হওয়ার পর থেকে বরাবর বাড়ির পুজো আমি নিজেই করে এসেছি।
গোস্বামীদা সাইট ইনচার্জ, আমি অনেকটা জুনিয়ার হলেও অলিখিত সেকেন্ড ইন্ কমান্ড। সকাল থেকে ঘ্যান ঘ্যান করে চলেছি "রবিবার বাড়ি না গিয়ে সব ব্যবস্থা তো করে দিয়েছি, পরশুদিনের কোনো কাজ আটকাবে না। আমায় বাড়ি যেতে দাও, কাল সেকেন্ড হাফেই চলে আসবো।" গোস্বামীদা কিছুতেই রাজি না। শেষ অবধি সন্ধ্যে সওয়া সাতটার সময় বাড়ি ঢোকার আগে অমন "শর্তাধীন জামিন" মঞ্জুর করে গেল। হয়ত ভেবেছিল এখন আর কি করে যাবে।
কুকরাহাটি থেকে রায়চকের লাস্ট লঞ্চ পৌনে আটটায়। দূর্গাচক থেকে পৌঁছানো কার্যত অসম্ভব। মুহুর্তের মধ্যে হিসেব কষে শুধু বললাম, "তোমার গাড়িটা করে সিটি সেন্টার মোড়ে ড্রপ নিচ্ছি।" ড্রাইভার তপনের সাথে আমার খুব ভাল সম্পর্ক ছিল। বলল "চৌধুরীদা, মেচেদার লাস্ট বাস তো সাড়ে সাতটায়, পাবে না।" "তুই চালা। ট্রাক ধরব। মেচেদা থেকে নটা চল্লিশের লাস্ট লোকাল ঠিক পেয়ে যাব।" সিটি সেন্টার পৌঁছে তপন হাত দেখিয়ে কোনো মতে একটা ট্রাক দাড় করালো। কিন্তু সে নন্দকুমার অবধি যাবে। তাই সই। নন্দকুমার থেকে গাড়ি পেতে অবশ্য একটু দেরি হয়ে গেল। শেষ অবধি একটা ম্যাটাডোর (৪০৭) পেলাম, আরো গোটা পাঁচেক লোকজন সহ উঠলাম পিছনে খোলা ডালায়। মাঘ মাসের ঠাণ্ডা, কোনোমতে ড্রাইভারের কেবিন এর পিছনে ঠেস দিয়ে বসে। ম্যাটাডোর মেচেদা পৌঁছালো প্রায় দশটা, লাস্ট লোকাল বেরিয়ে গেছে। যদিও ম্যাটাডোর হাওড়া যাবে, কিন্তু বাকিরা ওই ঠান্ডায় যেতে রাজি নয়। একজন বলল ১০:১৫ তে নাকি আরেকটা লোকাল আছে, সাঁতরাগাছি অবধি। আমিও একা রিস্ক না নিয়ে দৌড়ালাম স্টেশনে। কিন্তু হা ভগবান, সেই লোকাল সেদিন ক্যান্সেল। হলদিয়া থেকে রওনা হওয়ার সময় বাড়িতে ফোন করে বলেছিলাম, আসছি। স্বাভাবিকভাবে বাড়িতে সবাই চিন্তায়, তাই ফোন করে বলে দিলাম, "আসছি না। হলদিয়া ফিরে যাচ্ছি।"
স্টেশনের বাইরে দাড়িয়ে ভাবছি, কি করা যায়। হলদিয়া ফেরার বাস ভোর চারটে। নাকি হাইওয়ে তে গিয়ে আবার ট্রাকের জন্যে দাড়াবো? এমন সময় নাকে একটা সুন্দর পরিচিত গন্ধ ভেসে এলো। তড়কা!!! নাক যেখানে টেনে নিয়ে গেল, দেখি ছোট্ট একটা গুমটি হোটেল। তড়কার গন্ধ পেয়ে পেটের ছুঁচো গুলোও তখন ডন বৈঠক চালু করেছে। ডিম তড়কা ও রুটি, সাথে পিয়াজ ও কাঁচা লঙ্কা। অমৃত।
পেট পুরে খেয়ে দাম দিতে এসেছি, দোকানি জিজ্ঞেস করলেন, "কোথায় যাবেন?" পুরো ঘটনাটা ওনাকে বলতেই - "আমার দোকান আরো ঘন্টা খানেক খোলা থাকবে। ততক্ষণ এখানেই বসুন। তারপর হাইওয়ে তে চলে যাবেন। সোয়া বারোটা নাগাদ দীঘা - নামখানা বাস আসবে, তাতে চলে যাবেন। তবে ভুলেও লরি বা ট্রাক থামাতে যাবেন না, উপর দিয়ে চালিয়ে দেবে।"
ওনার দোকান বন্ধ হতে হাইওয়ে তে গিয়ে দাড়ালাম। ভাগ্য ভালো, পৌনে বারোটায় দীঘা - সল্টলেক এলো। কোনোমতে উঠলাম। ভিতরে প্রসেনজিৎ এর সিনেমা চলছে টিভিতে। কোলাঘাট বা বাগনান আসতেই একটা সিট ও জুটে গেল। কন্ডাক্টার বলল, শিয়ালদহ অবধি যাবে। আমি টিকিট কেটে সিধা ঘুম।
শিয়ালদহ এ নামলাম প্রায় আড়াইটে। কোলে মার্কেটের সামনে থেকে একটা ট্যাক্সি ধরলাম, বাগুইআটি। বাড়ি পৌঁছে দাদাকে মোবাইলে কল করলাম, দরজাটা খুলে দিতেই, টুক করে বিছানায়। সকাল সাড়ে সাতটায় ঘুম ভাঙলো বাবার গলার আওয়াজে। "ফিরে যাচ্ছি বলেও উজড়িয়ে এসেছিস?" তাড়াতাড়ি করে উঠে বাথরুমে। ফ্রেশ হয়ে স্নান করে সটান পুজোর আসনে। দশটার মধ্যে পুজো শেষ। সাড়ে দশটার মধ্যে খিচুড়ি - আলুভাজা - ফুলকপির তরকারি - চাটনি খেয়ে রওনা। ধর্মতলা থেকে রায়চক - কুকরাহাটি হয়ে পাতিখালির সাইটে যখন পৌঁছাই, তখন প্রায় তিনটে।
এক ঘন্টা লেট হওয়ার জন্যে অবশ্য গোস্বামীদা কিছু বলেনি। শুধু পুরো ঘটনা শুনে ও মোবাইলে বাড়ির পুজোর ছবি দেখে বলেছিল - "হাফ ম্যাড না ফুল?"
© সুব্রত চৌধুরী।
২২ শে জানুয়ারি ২০০৭। হলদিয়ায় কর্মরত, সিমপ্লেক্স এ। টাটা হুগলি মেট কোক প্রজেক্টের সেকেন্ড ফেসের প্রীকাস্ট পাইলিং এর কাজ। ২৪ তারিখ প্রথম পাইল কাস্ট হবে ও হেড অফিস থেকে অনেক বড় সাহেব আসবেন। CEO ও আসতে পারেন। কিন্তু গোল বেঁধেছে এই যে ২৩ তারিখ সরস্বতী পুজো। এবং পৈতে হওয়ার পর থেকে বরাবর বাড়ির পুজো আমি নিজেই করে এসেছি।
গোস্বামীদা সাইট ইনচার্জ, আমি অনেকটা জুনিয়ার হলেও অলিখিত সেকেন্ড ইন্ কমান্ড। সকাল থেকে ঘ্যান ঘ্যান করে চলেছি "রবিবার বাড়ি না গিয়ে সব ব্যবস্থা তো করে দিয়েছি, পরশুদিনের কোনো কাজ আটকাবে না। আমায় বাড়ি যেতে দাও, কাল সেকেন্ড হাফেই চলে আসবো।" গোস্বামীদা কিছুতেই রাজি না। শেষ অবধি সন্ধ্যে সওয়া সাতটার সময় বাড়ি ঢোকার আগে অমন "শর্তাধীন জামিন" মঞ্জুর করে গেল। হয়ত ভেবেছিল এখন আর কি করে যাবে।
কুকরাহাটি থেকে রায়চকের লাস্ট লঞ্চ পৌনে আটটায়। দূর্গাচক থেকে পৌঁছানো কার্যত অসম্ভব। মুহুর্তের মধ্যে হিসেব কষে শুধু বললাম, "তোমার গাড়িটা করে সিটি সেন্টার মোড়ে ড্রপ নিচ্ছি।" ড্রাইভার তপনের সাথে আমার খুব ভাল সম্পর্ক ছিল। বলল "চৌধুরীদা, মেচেদার লাস্ট বাস তো সাড়ে সাতটায়, পাবে না।" "তুই চালা। ট্রাক ধরব। মেচেদা থেকে নটা চল্লিশের লাস্ট লোকাল ঠিক পেয়ে যাব।" সিটি সেন্টার পৌঁছে তপন হাত দেখিয়ে কোনো মতে একটা ট্রাক দাড় করালো। কিন্তু সে নন্দকুমার অবধি যাবে। তাই সই। নন্দকুমার থেকে গাড়ি পেতে অবশ্য একটু দেরি হয়ে গেল। শেষ অবধি একটা ম্যাটাডোর (৪০৭) পেলাম, আরো গোটা পাঁচেক লোকজন সহ উঠলাম পিছনে খোলা ডালায়। মাঘ মাসের ঠাণ্ডা, কোনোমতে ড্রাইভারের কেবিন এর পিছনে ঠেস দিয়ে বসে। ম্যাটাডোর মেচেদা পৌঁছালো প্রায় দশটা, লাস্ট লোকাল বেরিয়ে গেছে। যদিও ম্যাটাডোর হাওড়া যাবে, কিন্তু বাকিরা ওই ঠান্ডায় যেতে রাজি নয়। একজন বলল ১০:১৫ তে নাকি আরেকটা লোকাল আছে, সাঁতরাগাছি অবধি। আমিও একা রিস্ক না নিয়ে দৌড়ালাম স্টেশনে। কিন্তু হা ভগবান, সেই লোকাল সেদিন ক্যান্সেল। হলদিয়া থেকে রওনা হওয়ার সময় বাড়িতে ফোন করে বলেছিলাম, আসছি। স্বাভাবিকভাবে বাড়িতে সবাই চিন্তায়, তাই ফোন করে বলে দিলাম, "আসছি না। হলদিয়া ফিরে যাচ্ছি।"
স্টেশনের বাইরে দাড়িয়ে ভাবছি, কি করা যায়। হলদিয়া ফেরার বাস ভোর চারটে। নাকি হাইওয়ে তে গিয়ে আবার ট্রাকের জন্যে দাড়াবো? এমন সময় নাকে একটা সুন্দর পরিচিত গন্ধ ভেসে এলো। তড়কা!!! নাক যেখানে টেনে নিয়ে গেল, দেখি ছোট্ট একটা গুমটি হোটেল। তড়কার গন্ধ পেয়ে পেটের ছুঁচো গুলোও তখন ডন বৈঠক চালু করেছে। ডিম তড়কা ও রুটি, সাথে পিয়াজ ও কাঁচা লঙ্কা। অমৃত।
পেট পুরে খেয়ে দাম দিতে এসেছি, দোকানি জিজ্ঞেস করলেন, "কোথায় যাবেন?" পুরো ঘটনাটা ওনাকে বলতেই - "আমার দোকান আরো ঘন্টা খানেক খোলা থাকবে। ততক্ষণ এখানেই বসুন। তারপর হাইওয়ে তে চলে যাবেন। সোয়া বারোটা নাগাদ দীঘা - নামখানা বাস আসবে, তাতে চলে যাবেন। তবে ভুলেও লরি বা ট্রাক থামাতে যাবেন না, উপর দিয়ে চালিয়ে দেবে।"
ওনার দোকান বন্ধ হতে হাইওয়ে তে গিয়ে দাড়ালাম। ভাগ্য ভালো, পৌনে বারোটায় দীঘা - সল্টলেক এলো। কোনোমতে উঠলাম। ভিতরে প্রসেনজিৎ এর সিনেমা চলছে টিভিতে। কোলাঘাট বা বাগনান আসতেই একটা সিট ও জুটে গেল। কন্ডাক্টার বলল, শিয়ালদহ অবধি যাবে। আমি টিকিট কেটে সিধা ঘুম।
শিয়ালদহ এ নামলাম প্রায় আড়াইটে। কোলে মার্কেটের সামনে থেকে একটা ট্যাক্সি ধরলাম, বাগুইআটি। বাড়ি পৌঁছে দাদাকে মোবাইলে কল করলাম, দরজাটা খুলে দিতেই, টুক করে বিছানায়। সকাল সাড়ে সাতটায় ঘুম ভাঙলো বাবার গলার আওয়াজে। "ফিরে যাচ্ছি বলেও উজড়িয়ে এসেছিস?" তাড়াতাড়ি করে উঠে বাথরুমে। ফ্রেশ হয়ে স্নান করে সটান পুজোর আসনে। দশটার মধ্যে পুজো শেষ। সাড়ে দশটার মধ্যে খিচুড়ি - আলুভাজা - ফুলকপির তরকারি - চাটনি খেয়ে রওনা। ধর্মতলা থেকে রায়চক - কুকরাহাটি হয়ে পাতিখালির সাইটে যখন পৌঁছাই, তখন প্রায় তিনটে।
এক ঘন্টা লেট হওয়ার জন্যে অবশ্য গোস্বামীদা কিছু বলেনি। শুধু পুরো ঘটনা শুনে ও মোবাইলে বাড়ির পুজোর ছবি দেখে বলেছিল - "হাফ ম্যাড না ফুল?"
© সুব্রত চৌধুরী।
Comments
Post a Comment