টিউশন, ইনফ‍্যাচুয়েশন ও বিজয়ার এসিমিলেশন। (শেষ পর্ব)



বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে ফিরেছিল দুজনে সেদিন। কত কথা, বৃষ্টির আওয়াজও দমাতে পারেনি দুজনের ভোকাল কর্ড ও কানকে। কোচিংয়ে কাউকে বুঝতে না দিয়েও ভালোই চলছিল দুজনের প্রেমপর্ব। অটো থেকে দু স্টপ আগে নামাটা এখন রোজনামচা পারমিতার। আদৃজা ও পিয়ালী দু একবার জিজ্ঞেস করায় গানের ক্লাসের কথা বলেছে। সাইকেলে পিছু পিছু সুদীপ এলেই কিছুটা পথ একসাথে চলা। জমানো কথা বলার একমাত্র সময় দুজনের।

দেখতে দেখতে আরেক ইঁদুর দৌড়ের সময় উপস্থিত। সবাই জয়েন্টের ফর্ম ফিলআপ করেছে। সুদীপের যদিও কেমিস্ট্রি নিয়ে গ্রাজুয়েশন করার দিকেই মন পড়ে। সবাই যদি ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হবে, তো বাকি সাবজেক্ট গুলো কি হারিয়েই যাবে? বাড়ির সবার ও পারমিতার পীড়াপীড়িতে যদিও ভরতেই হয়েছে জয়েন্টের ফর্ম। পরীক্ষাতেও বসেছিল।
উচ্চমাধ্যমিকে সুদীপ কেমিস্ট্রি ও অংকে লেটার সহ স্টার। দেবা এবং পিয়ালীও স্টার, পারমিতা, আদৃজা সহ বাকিরাও ফার্স্ট ডিভিশন, বিশ্বজিৎ একমাত্র সেকেন্ড ডিভিশন। তবে জয়েন্টে হয়নি সুদীপের। সিট মোটে ২০০০, তাই হয়নি বলে দুঃখ নেই সুদীপের, কিন্ত পারমিতার খুব মন খারাপ। সুদীপ পায়নি, ও নিজেও পায়নি ডাক্তারিতে।

ডঃ রায় মেয়ের ডাক্তারি পড়ার ব্যবস্থা করেন মনিপাল, কর্নাটকে। কি করবে কিছুই বুঝতে না পেরে পারমিতা দিদিকে ব্যাপারটা কিছুটা জানিয়েছিল। প্রেসিডেন্সিতে কেমিস্ট্রি অনার্সের প্রবেশিকার পরীক্ষা শেষে পারমিতার সাথে কফি হাউসে দেখা হবে, সুদীপ বেশ ফুরফুরে মেজাজে। কফি হাউসে পৌঁছে পারমিতার সাথে ওর দিদিকে দেখে একটু দমে গেল।
মৌমিতা রায়, কলকাতা মেডিকেল কলেজ, এমবিবিএস থার্ড ইয়ার। প্রতিনমস্কার জানিয়ে বসতেই মৌমিতা জিজ্ঞেস করল, "পরে কথা হবে, আগে কি খাবে বলো?"
"আপনিই বলুন"
"নিজেরা তুই তুই করে কথা বলো, আর আমায় আপনি? আমি পারোর থেকে মাত্র তিন বছরের বড়। আমায় তুমি বলতে পারো। মটন কাটলেট আর কফি বলি? আমাদের যদিও এক কাপ করে খাওয়া হয়ে গেছে।"
সুদীপের পরিবারের কথা, পড়াশোনা নিয়ে পরিকল্পনা, জানতে চায় মৌমিতা, চুপ করে শুনে ছোট বোন। বাড়ি ফিরে সন্ধ্যেবেলা দুই বোনে একসাথে বাবা-মা কে জানায়। সুদীপ পড়াশোনায় মেধাবী, মধ্যবিত্ত পরিবার হলেও স্বচ্ছল। ডঃ রায় সব শোনেন মন দিয়ে। দুই মেয়ে তার দুই নয়নের মনি। মিসেস রায়ের অবশ্য ছোট মেয়ের উপরেই রাগ "এই সব টিন-এজ ইনফ্যাচুয়েশন। মেধাবী ছেলে, খেলাধুলায় ভালো, মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে মাথাটা খেয়েছে তোমার। প্রেসিডেন্সিতে পড়বে, না ছাতার মাথা, দু দিন বাদে দেখবে হয় কাঁধে ঝোলা নিয়ে কফি হাউসে আতলামি করছে, নয় ছাত্র নেতা হয়েছে। কোনো দরকার নেই সম্পর্ক রাখার। সপ্তাহ তিনেক বাকি, নিজের মনিপাল যাওয়ার গোছগাছ কর।"
ডঃ রায় সহধর্মিণীকে থামিয়ে শুতে যাওয়ার আগে বলেন "সুদীপকে বল, মনিপাল ইউনিভার্সিটির বিটেক কোর্সে এপ্লাই করতে।"
পারমিতা পরদিন সুদীপকে মনিপাল ইউনিভার্সিটির কথা বলতে, সুদীপের চোখ কপালে। "সে তো প্রাইভেট কলেজ, মাস মাইনে ছাড়াও হোস্টেল খরচ, আমার বাবা-মা'র পক্ষে সম্ভব না।"
"বলেই দেখ না একবার বাড়িতে?"
"আমি জানি, লাভ নেই। আর যদি রাজিও হয়, তাহলেও পরীক্ষা হয়ে যাওয়ার পর এখন আমায় কি ওখানে মুখ দেখে ভর্তি নেবে? ক্যাপিটেশন ফি কোথায় পাবে বাবা?"
"বাপি দিয়ে দেবে।" কথাটা বলেই পারমিতা বুঝতে পারল এই ভাবে বলাটা ভুল হয়ে গেছে। বিনা বাক্যে দুজনে নিজেদের বাড়ির পথ ধরে।

এয়ারপোর্টে এসেছে সুদীপ। মেয়েকে নিয়ে ডঃ রায় নিজে যাচ্ছেন এডমিশন করাতে। দেখতে পেয়ে মৌমিতা ডাক দেয় সুদীপকে, নতুন করে আলাপ করিয়ে দেয় বাবা-মা'র সাথে। ডঃ রায় হ্যান্ডশেক করে সুদীপকে নিজের বউয়ের থেকে একটু তফাতে নিয়ে আসেন।
"সুদীপ তুমি বুদ্ধিমান। আমার মেয়ে না বললেও তুমি ঠিকই ধরে ফেলতে ক্যাপিটেশন ফি এর ব্যাপারটা। তবে আমি বলি কি, জেনারেল লাইনে পড়ে সেরকম কিছু ভবিষ্যৎ নেই। তুমি এই বছরটা ভালো করে জয়েন্টের প্রিপারেশন নাও। নেক্সট ইয়ার টার্গেট কর।"
কথার মাঝে কখন পারমিতা এসেছে, খেয়াল করেনি সুদীপ।
"ঠিক বলেছ বাপি। তুই নেক্সট ইয়ারের প্রিপারেশন শুরু কর।"
টুকটাক কথা বলে বাবা-মেয়ে টার্মিনালে ঢুকে যেতে সুদীপের খেয়াল হয়, প্রেসিডেন্সিতে কেমিস্ট্রি অনার্সে চান্স পাওয়ার কথাটা বলাই হয়নি।

দিন কয়েক বাদে প্রেসিডেন্সির সামনে সুদীপকে দেখতে পায় মৌমিতা। মৌমিতা হয় দুজনের চিঠি চালাচালির দূত। কলেজের ছুটিতে একবার প্লেনে কলকাতা আসলেও পারমিতা ট্রেনেই যাতায়াত করতো। সুদীপের মামা সাউথ ইস্টার্ন রেলের টিটি। মামার পরিচয় ভাঙিয়ে ফেরার ট্রেনে হাওড়া থেকে খড়গপুর অবধি যেত একসাথে।

বছর ঘুরে আবার জয়েন্ট এন্ট্রান্স। কিন্তু না, এবারও হয়নি সুদীপের। জয়েন্টের রেজাল্ট বেরোবে শুনে রিটার্ন টিকিট কেটেই কলকাতা এসেছিল পারমিতা। সারপ্রাইজ দেবে ভেবেছিল। হয়নি শুনে রাগে দুঃখে ফিরে যাচ্ছিল, সুদীপকে খবর না দিয়েই। মৌমিতার থেকে জানতে পারে সুদীপ।

হাওড়া স্টেশন থেকে ছাড়তে থাকা চলন্ত ট্রেনে দৌড়ে ওঠে সুদীপ।
"আমি তোর কোনো কথা শুনতে চাই না। তোর মুখ দেখতে চাই না আমি।"
অনেক করে বোঝায় সুদীপ, তবু রাগ কমে না পারমিতার। খড়গপুর আসতে সুদীপ নামার জন্য পা বাড়ায়, শেষ বারের মতো বলে "ভরসা রাখ আমার উপর। আমি কেমিস্ট্রি অনার্স নিয়ে পড়েও লাইফে দাঁড়াতে পারবো। আমার জন্য তোকে বাড়িতে কথা শুনতে হবে না, তুই দেখিস, আমি পারবো।"
"ছাই পারবি। স্টার পেতে পারিস, আর একটা জয়েন্টে চান্স পেতে পারিস না? বাপি ক্যাপিটেশন ফি দিয়ে ভর্তি করিয়ে দিত, তাও পোষাল না। কি পারবি? ট্রেন ছাড়ার আগে প্লাটফর্ম থেকে আলুরদম এনে দিতে পারবি আমায়?"

প্লাটফর্মে নেমে শালপাতার বাটিতে রাখা লাল মাখা মাখা আলুরদম নিতে নিতেই একটা ধাতব শব্দ শুনতে পেল। দরজাটা সশব্দে বন্ধ করে লক করে দিয়েছে পারমিতা। আলুরদমটা হাতেই রয়ে যায়।

বিজয়ার খাবার হাতে করে নিয়ে এসে যে সম্পর্কের শুরু, তার বিসর্জন বোধহয় বিধাতা, সেইদিনই লিখে রেখেছিলেন। নাকি ইঁদুর দৌড় ও সমাজ??? (সমাপ্ত)

© সুব্রত চৌধুরী

Disclaimer - The incidents and characters are a work of fiction and Resemblance to any person is purely coincidental.

ছবি - কাটলেট © Indrajit Lahiri (www.moha-mushkil.com)
ছবি - আলুরদম ©Kotha Khaoa (https://kothakhaoa.wordpress.com/ )





Comments

Popular posts from this blog

কার্তিক পুজো ও খাওয়াদাওয়া

তালশাঁস সন্দেশ

পুজো ও বামুন