"ঘঞ্চা বুড়িটা"
২৮শে মে, ২০১০। টাটা পাওয়ারের ইউনিট ফাইভ এ কর্মরত (টাটা কনসাল্টিং ইঞ্জিনিয়ার্স এর হয়ে)। মহারানী তখন কলকাতায়, ডেলিভারির ডেট জুনের ফার্স্ট উইক। সকাল সাড়ে ন'টা বাজে, ১৬১ মিটার উঁচু চিমনির কাজ চলছে, এমন সময় মহারানীর ফোন।
"খবর দেখেছো?"
"কি হয়েছে?"
"ঝাড়গ্রামের কাছে বিশাল ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটেছে। খড়গপুর থেকে টাটানগরের মধ্যে সমস্ত ট্রেন চলাচল বন্ধ।"
"তাই নাকি? কখন হল? কি করে? হতাহতের সংখ্যা কত?"
"অনেক লোক মারা গেছে। কিন্তু তুমি দুর্ঘটনা ছেড়ে অন্য কথাটা শোন।"
"কি হয়েছে?"
"আমার না শরীরটা কেমন করছে। বাবা - মা এখন ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাচ্ছে। যদি অ্যাডমিট করে, তাহলে তুমি কি করে আসবে?"
"কি হয়েছে?"
"ঝাড়গ্রামের কাছে বিশাল ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটেছে। খড়গপুর থেকে টাটানগরের মধ্যে সমস্ত ট্রেন চলাচল বন্ধ।"
"তাই নাকি? কখন হল? কি করে? হতাহতের সংখ্যা কত?"
"অনেক লোক মারা গেছে। কিন্তু তুমি দুর্ঘটনা ছেড়ে অন্য কথাটা শোন।"
"কি হয়েছে?"
"আমার না শরীরটা কেমন করছে। বাবা - মা এখন ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাচ্ছে। যদি অ্যাডমিট করে, তাহলে তুমি কি করে আসবে?"
আমরা একে ওপরকে কথা দিয়েছিলাম। সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময় দুজনে পাশাপাশি থাকবো। কথাটা শুনেই মাথাটা ভোভো করতে লাগলো। কোনোমতে বললাম, "দেখ ডাক্তার কি বলে। অন্তত কালকের দিনটাও যদি সময় পাওয়া যায়।"
বিকেলবেলা চারটে নাগাদ এলো ফোন, "কাল ভর্তি হতে বলেছে। জল কমে আসছে, কাল অবজারভেশন এ রাখবে, উন্নতি না হলে রবিবার সিজার।"
ডাইরেক্ট ট্রেন রুট বন্ধ। সমস্ত পশ্চিমমুখী ট্রেন বাঁকুড়া পুরুলিয়া দিয়ে ঘুরিয়ে দেওয়ায় সেই রুটের ট্রেনের কোন সময়ানুবর্তিতা নেই। গেলাম ট্রাভেলস এর কাছে, যদি ক্যাব পাওয়া যায়। বেঙ্গল বর্ডার সিল করে দিয়েছে, চেকিং মারাত্বক, তাই কেউ রাজি নয়। ঠিক করলাম, ভোরবেলা বাইক নিয়েই যাব। কিন্তু আমার ডানপিটে স্বভাব জানত বলেই রাতে ফোন করে মহারানী বললেন "তুমি কিন্তু বাইক নিয়ে আসবে না, আমার দিব্বি।"
আবার প্ল্যানিং চালু। দেখলাম, দুপুরে টাটা ধানবাদ একটা ট্রেন আছে, সেটা আদ্রা পৌঁছায় যে সময়, তার কিছুক্ষণ বাদে ওখান থেকে একটা বর্ধমান লোকাল আছে। যেটা বর্ধমান পৌঁছায় রাত সাড়ে সাতটা আটটায়। ওখান থেকে হাওড়া যাওয়ার কোনো না কোনো গাড়ি ঠিক পেয়ে যাব।
২৯শে মে, সকালে অফিস পৌঁছে কাজকর্ম বুঝিয়ে বেরোতে যাব, এক জুনিয়র বলল "আমিও যাব।" যত বলি, আমার স্ত্রী হসপিটালে, তাই যাচ্ছি, তোর উজরিয়ে যাওয়ার কি হয়েছে? সে নাছোড়বান্দা। দুজনে এসে উঠলাম সুবর্ণরেখা এক্সপ্রেসে। ট্রেন রুট কঞ্জেস্টেড হয়ে যাওয়ায় আমাদের ট্রেনটা কে আদ্রার আউটারে দাড় করিয়ে বর্ধমান লোকাল টা পাস করিয়ে দিল। আদ্রা পৌঁছে লোকজন কে জিজ্ঞেস করছি, হাওড়া যাওয়ার কি ব্যবস্থা হতে পারে, একজন উল্টোদিকের প্লাটফর্মে দাড়ানো ট্রেনটা দেখিয়ে বলল "ওটায় উঠে যান। রাঁচি খড়গপূর এক্সপ্রেস।"
বলতে বলতে ট্রেনের সিগন্যাল হয়ে গেছে দেখে লাইন পেরিয়ে উল্টো দিক দিয়ে সবে চলতে থাকা ট্রেনে উঠলাম। উঠে বুঝলাম, ওটা প্যাসেঞ্জার ট্রেন। যাই হোক, চলেছি তাও, হঠাৎ খেয়াল হল আমাদের কাছে টিকিট নেই। টিটি আসতে তাকে সত্যি কথাটাই বললাম। উনি বললেন "গড়বেতায় নেমে হাওড়ার টিকিট কাটুন। এই ট্রেন ছেড়ে দিয়ে পিছনে রূপসী বাংলা আসছে, তাতে উঠে পড়ুন। গড়বেতা ও মেদিনীপুরের মাঝে যদি ওকে পাস করিয়ে দেয়, তাহলে খড়গপুড় পৌঁছে কোনো লাভ হবে না।"
বলতে বলতে ট্রেনের সিগন্যাল হয়ে গেছে দেখে লাইন পেরিয়ে উল্টো দিক দিয়ে সবে চলতে থাকা ট্রেনে উঠলাম। উঠে বুঝলাম, ওটা প্যাসেঞ্জার ট্রেন। যাই হোক, চলেছি তাও, হঠাৎ খেয়াল হল আমাদের কাছে টিকিট নেই। টিটি আসতে তাকে সত্যি কথাটাই বললাম। উনি বললেন "গড়বেতায় নেমে হাওড়ার টিকিট কাটুন। এই ট্রেন ছেড়ে দিয়ে পিছনে রূপসী বাংলা আসছে, তাতে উঠে পড়ুন। গড়বেতা ও মেদিনীপুরের মাঝে যদি ওকে পাস করিয়ে দেয়, তাহলে খড়গপুড় পৌঁছে কোনো লাভ হবে না।"
ওনার পরামর্শ মত শেষ অবধি রূপসী বাংলা ধরেই হাওড়া স্টেশন পৌঁছই রাত পৌনে বারোটায়। সেখান থেকে জুনিয়রটি লাস্ট লোকাল ধরে ব্যান্ডেল ও আমি পায়ে হেঁটে শ্বশুরবাড়ি। ৩০শে মে, সকাল হতেই নার্সিংহোমে। সকাল থেকে ওটি তে নিয়ে যাওয়ার আগে অবধি পাশেই ছিলাম। এবং দুপুর দেড়টা নাগাদ একটা ট্রেতে করে আমার সামনে নিয়ে আসে আমাদের রাজকুমারীকে। সেই দেখার অনুভূতি বোধহয় কোনোদিন ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়।
আজ আট বছর বয়স হলো তার। সেই মাটির দলা, আমার "ঘঞ্চা বুড়িটা" এখন আমাকেই শাসন করে। শুভ জন্মদিন।
Comments
Post a Comment