ইডেন ডায়েরি
ইডেন গার্ডেনে বহু ম্যাচ দেখেছি। কিন্তু আগের দিন আন্দ্রে রাসেল যা মারলো, এমন বোধহয় কমই দেখেছি। সচিনের টেস্ট সেঞ্চুরি দেখেছি, ক্লুস্নারের এক ওভারে আজহারের পরপর চারটে (না পাঁচটা) চার মারতে দেখেছি, অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ভারতের প্রথম ছজন ব্যাটসম্যানের হাফ সেঞ্চুরি দেখেছি (আজহার ১৫০+)। একমাত্র বীরেন্দ্র সেহ্বাগ এর ৮৭ বলে সেঞ্চুরি বোধহয় এর সাথে তুলনায় আসতে পারে।
আর অবশ্যই আসতে পারে রাহুল দ্রাবিড় ও লক্ষণ এর ঐতিহাসিক ব্যাটিং। মার্চ ২০০১।
আমি তখন ডিপ্লোমা পাশ করে একপ্রকার বেকার। একটা ফুটবল টুর্নামেন্ট (খেপ) খেলতে গিয়ে বাঁদিকের কাঁধ ও হাতের জয়েন্ট ডিসলোকেট হয়ে যায়। ফলত ডাক্তার হাত সেট করে ডাইনা প্লাস্ট দিয়ে আটকে দেয় ও আমি মোটামুটি বা হাত কাটা হিসেবে ঘুরে বেড়াই। চেনাশোনা থাকায় আমি আর আমার বন্ধু টুলু বরাবর ইডেনের টিকিট পেতাম। সেবারও পেয়েছিলাম, বেশ কয়েকটা।
বাবার কাছ থেকে দৈনিক বরাদ্দ পঁচিশ টাকা। বাস ভাড়া আসাযাওয়া মিলিয়ে পাঁচ টাকা, বাকি কুড়ি টাকায় সারাদিনের খাওয়া দাওয়া ও বিড়ি সিগারেট। খাওয়া দাওয়া বলতে হাইকোর্টের সামনে পনেরো টাকায় ডাল ভাত আলু ভাতে ও ক্ষুদ্র এক পিস মাছ, ঝোল সহ।
চুতর্থ দিন সকালে বেরোবো, বাবা বললেন "কি করতে যাবি?" ফলো অন করে দ্বিতীয় ইনিংসে চার উইকেট পড়ে গেছে। তাও বেরোলাম, আমার ও টুলুর মিলিয়ে পকেটে সাতটা টিকিট। পাড়ার মুখে এক সিনিয়ার ও দুই বন্ধু যারা কোনোদিন ইডেন যায়নি, তাদের সাথে দেখা। বলল যাবে, নিয়ে নিলাম, বাস ভাড়া ও খুচরো খাবারের দায়িত্ব তাদের।মেট্রোর সামনে টিকিট চেঞ্জ করে টুলু বাকিদের নিয়ে চলে গেল, আমি বাকি টিকিটের বন্দোবস্ত করার জন্য রয়ে গেলাম। বারো নম্বর গেটে আমাদের বসার জায়গাটা মোটামুটি একই ছিল। একহাত জামার ভিতর থাকার দরুন, মাঠের ডিউটিরত পুলিসরাও আমায় চিনে গেছিল।
বাকি দুটো টিকিট (একটা এগারো, একটা সাত নম্বর গেট) বেঁচে পেলাম সত্তর টাকা মোটে। লাঞ্চের পর সত্তর টাকার বড়োলোক হয়ে মুরগির মাংস ভাত খেতে খেতে কপাল চাপড়াতে ইচ্ছে করছিল, একেকটা টিকিট তখন আড়াইশো টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যারা মাঠে গেছেন, গ্যালারিতে কেমন তুকতাক চলেন হয়ত জানেন। সেদিন দিনভর আমায় সামনের সিটের উপর পা রেখে বসে থাকতে হয়েছিল কারণ প্রথম যখন পা তুলেছিলাম, লক্ষণ প্রথম চার মেরেছিল। প্রথম দিনে হরভজনের হ্যাটট্রিকের সময়ও একটা কেস ছিল, পরে আসছি।
পঞ্চম দিন সকালে পকেটে পাঁচটা টিকিট। চতুর্থ দিন সাথে যাওয়া এক বন্ধু বলল "দেখ আমি লাকি, আমায় নিয়ে চল।" সাথে আরো দুই বন্ধু এলো, তারা অবশ্য নিজেদের টিকিট জোগাড় করেই এসেছে।বাকি দুটো টিকিটের কথা আমরা বেমালুম চেপে গেলাম, কারণ ঠিক করেই রেখেছিলাম ওই দুটো বেঁচে পাঁচদিনের খরচ তুলব। মেট্রোর সামনে দাড়িয়ে অনেক চিল্লিয়েও শেষ অবধি চারটে ১২ ও একটা ১১ হল। পকেটের বাকি দুটো ৭ ও ৫ নম্বর গেটের। ১১ নম্বরে যেতে কেউ রাজি নয়। শেষ অবধি আমি বললাম ১১ নম্বরের টিকিট আমায় দিতে। টুলুকে বললাম, রোজ যেখানে বসছি, সেইখানেই বসবি আর আমার জায়গা রাখবি। সবাই চলে যেতে দুটো টিকিট বেচলাম ৩৫০ টাকায়। গেটের কাছে পৌঁছে শেষ চেষ্টা করলাম টিকিট বদলাবার, হলো না। অগত্যা ১১ দিয়েই ঢুকলাম। ভাগ্য সেদিন বিশাল। ১১ দিয়ে ঢুকেই ১২র সিড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি চার দিনের মুখ চেনা এক পুলিশ। "মামা!! আজকে জিতব তো?" চিৎকার করে তার দিকে এগোতেই বলল, "এই হাত নিয়ে আজকেও এসছিস, যা ভাগ!!" এই কথোপকথন শুনে আর কেউ ঘাটালো না। আমিও টিকিট পকেটে রেখেই ওনার সাথে একথা সেকথা বলে সিধা বন্ধুদের মধ্যে গিয়ে বসলাম।
কিছুক্ষণ বাদে ডিক্লেয়ার করলো সৌরভ। লাঞ্চ অবধি এক উইকেট পড়লো। চা অবধি আরো দুটো। টি ব্রেকের পর যখন হরভজন বল করতে এলো, টুলু বলল "ফার্স্ট ডে তে উল্টো বিড়ি ধরিয়েছিলি আর হ্যাটট্রিক হয়েছিল না? একটা ধরা না।" এবং ধরাতেই স্টিভ ওয়া আউট। তারপর পন্টিং। ওভার শেষ ও আমি বিড়ি ফেলতেই আশপাশের লোকজন এই মারে কি সেই মারে। জবরদস্তি আবার বিড়ি (উল্টো) এবং সচিন গিলেস্পি বা গিলক্রিস্ট কে। আর যায় কোথায়!! বাকি ম্যাচটা ইচ্ছা না হলেও সারাক্ষণ উল্টো বিড়ি ফুকতে হলো।
খেলা শেষে টিকিট বেচার পয়সায় সাবিরের রেজালা ও রুটি খেয়ে ট্যাক্সি করে বাড়ি ফিরেছিলাম।
©সুব্রত চৌধুরী
Comments
Post a Comment