চিমনি, চাক ও চা

"স্যার বাঁচান!!" একটা করুন আর্তি শুনে লেবু চা খেতে খেতে মুখ তুলে তাকালাম। টাটা স্টিলের সাকচি গেটের বাইরেই মেন রোডের কাছে চা খাচ্ছিলাম। একটা সিকিউরিটি গার্ড একটি লেবারকে পাকড়াও করে কয়েক ঘা দিয়ে গেটের দিকে নিয়ে যেতে উদ্যত। আমি এগোতে ও সিকিউরিটি আমার আই কার্ড দেখে একটু ঢিল দিতেই, সে ছোড়া দে ছুট।
কি কেস? আমি কিছুটা জানতাম, তাই অনেক কষ্টে হাসি চেপে দাড়িয়ে আছি। সিকিউরিটি তখন বলেই চলেছে, "কিতনা হারামী লড়কা হ্যায়, দুবারা মিলা তো ভর্তা বানা দুঙ্গা।"

২০০৮ সাল। আমি তখন পাওয়ার প্ল্যান্টে কংক্রিটের চিমনি বানানো সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। টাটা কনসাল্টিং ইঞ্জিনিয়ার্স এর হয়ে টাটা স্টিলের ভিতরে ১৪৫ মিটার (প্রায় ৪৮০ ফুট) উচু চিমনি বানানোর তদারকিতে। মূল কাঠামো বা শেল তৈরি হয়ে গেছে। বাইরের প্ল্যাটফর্মের ঢালাই ও হয়ে গেছে। রেলিং লাগানো ও রঙের কাজ চলছে।

হঠাৎ একটি প্ল্যাটফর্মের নিচে মৌমাছিরা চাক বাঁধলো। প্রায় ৭৫ মিটার হাইটে। কিছুতেই ওই পাশে কাজ করতে দিচ্ছে না। কেউ গেলেই হুল মারে। পেস্ট কন্ট্রোল থেকে টাটা স্টিলের ভিতরে মৌমাছির চাক ভাঙার লোকজন, কেউই ওই উচ্চতায় গিয়ে ঝুলে ঝুলে কাজ করতে রাজি নয়। বেশি পয়সা দিলেও নয়। এদিকে দিন দিন চাক বড়ো হচ্ছে। শেষমেষ রঙের মিস্ত্রি দের মধ্যে একজন বলল, "স্যার, দু দিন টাইম দিন। আমি কাজটা করে দিতে পারি সোমবার, বাড়ি থেকে ফিরে। তবে ৪০০০ টাকা লাগবে আর চাকটা আমি নিয়ে যাবো।"
"সে তো ঠিক আছে, কিন্তু তোকে হুল মারলে, ব্যথায় বা ভয়ে যদি পড়ে যাস, আমার হাতে হাতকড়া পড়বে তো?"
"কিছু হবে না স্যার। আমার বাড়ি পুরুলিয়ায়। আমি বাড়ি থেকে জিনিস নিয়ে আসবো। আমায় কামড়াবে না।"

যেমন বলা তেমনই কাজ। গ্রাম থেকে কি শিকড় বাকড় নিয়ে এলো, কে জানে। আমাদের বললো শুধু, কিন্তু কিছুই দেখালো না।

লোহার খাচায় করে ঝুলতে ঝুলতে গন্তব্যে পৌঁছে দিব্যি একটা সিমেন্টের বস্তা নিচ থেকে গলিয়ে চাক কেটে বস্তার মুখ বন্ধ করে নিচে নিয়ে চলে এলেন বাবু। এসে বললেন, "আমি ওই জায়গায় শিকড় ঘষে দিয়েছি, ওই লেভেলে আর চাক বাঁধবে না।" কি ছিল জানি না, তবে ওকে একটা মৌমাছির কামড় যে খেতে হয়নি, তা নিজের চক্ষেই দেখলাম।

টাকাটা গুনে নিয়ে বস্তা কাধে ফেলে যাওয়ার আগে চোখ টিপে বলে গেল, "মাস খানেক বাদে আসবো স্যার। গেটের সিকিউরিটি গুলো বড্ড জ্বালাচ্ছে কদিন, যাই।" কাজ হয়ে যাওয়ায় আমিও বাইক নিয়ে রওনা দিলাম লেবু চা খেতে।

সাকচি গেট দিয়ে, বাবু কাধে বস্তা ঝুলিয়ে, বেরোনোর চেষ্টা করতেই সিকিউরিটি ক্যাচ কট কট। "এই রোকো!!! কাহা ভাগ রহা হায়? দিখাও উসমে ক্যা হায়?"
যাকে উদ্দেশ্য করে হাঁক ডাক, সে ব্যাটা "ঠিক হায়, দেখ লিজিয়ে" বলে কাঁধের বস্তাটা মাটিতে নামিয়ে ধীর পায়ে গেটের বাইরে। সিকিউরিটি বস্তার মুখ খুলতেই মৌমাছির আক্রমণ। আর উনি দে দৌড়। মৌমাছির হুল খেয়ে এক সিকিউরিটি দৌড়ে করিম সিটি কলেজের সামনে থেকে ধরে আনছিল ব্যাটাকে। মাঝখান থেকে আমার লেবু চা খাওয়াটা মাটি করে দিলো।

©সুব্রত চৌধুরী


Comments

Popular posts from this blog

কার্তিক পুজো ও খাওয়াদাওয়া

তালশাঁস সন্দেশ

পুজো ও বামুন