"বাঘের বাচ্চা"
আমার মতো অতটা রোগা না হলেও, ডিপ্লোমা তে আমাদের এক বন্ধু ছিল, আমরা "বাঘের বাচ্চা" ডাকতাম (ফ্রেন্ডলিস্টে আছে, তাই নাম নিলাম না)।
আমাদের সাথেই পড়ত পলাশ, বাঁকুড়ায় বাড়ি। ওর দিদির বিয়েতে সব বন্ধুদের নেমন্তন্ন। পলাশ ও অন্য বন্ধুরা এসে বাড়িতে বলায় ছাড়পত্র মিলল যাওয়ার। রবিবার বিয়ে, তাই শনিবার সকালেই ব্যাগ গুছিয়ে কলেজ, ওখান থেকে সোজা বাঁকুড়া যাওয়া হবে।
"বাঘের বাচ্চা" যাবে না। বিয়ের দুদিন বাদেই ছাত্র সংসদ নির্বাচনের মনোনয়ন জমার শেষ দিন। ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের দরুন প্রতিপক্ষ হলেও, আমরা অভিন্ন হৃদয় বন্ধু। শনিবার আবার বললাম। চল, তুই আর আমি না হয় ফার্স্ট ব্যাচে খেয়ে রাতের ট্রেনে চলে আসবো। মঙ্গলবার অবধি সময় আছে। হটাৎ বাবুর সুমতি হলো। বললো চল বাড়িতে, মা কে বলে ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে আসি। যাদবপুর স্টেশন থেকে ট্রেনে শিয়ালদহ, সেইখান থেকে হেঁটে অখিল মিস্ত্রি লেনের কাছে ওদের বাড়ি। একরাশ প্রশ্নবাণ সামলে কাকিমার থেকে ছাড়পত্র আদায় হলো। বললেন, খেয়ে রওনা হও।
সিন - ১ (দুপুর আড়াইটে) দুজনে পাশাপাশি বসেছি। কাকিমা থালায় আখের গুড় ও আলুর তরকারির সাথে খান দশেক করে রুটি দিয়ে আবার রুটি বানাতে গেলেন। আমার তো আঁতকে ওঠার জোগাড়। কাকিমাকে বলতে যাবো, পাশ থেকে, মুখে রুটি ঠুসে, বাবু বলে উঠলেন "উঃ উঃ, রেখে দে, আমি নিয়ে নেব"। দু-তিনটে রুটি খেয়ে আমি উঠে গেলেও "বাঘের বাচ্চা" গুনে গুনে বত্রিশটা (আজ্ঞে হ্যা, ৩২) রুটি খেলেন।
কাকিমাকে প্রনাম করে, হেঁটে শিয়ালদহ সাউথ। এবার গন্তব্য গড়িয়া, পলাশদের মেস। গড়িয়া স্টেশন থেকে হেঁটে, ধরুন ৮বি থেকে বেঙ্গল ল্যাম্প হবে। পলাশ বাড়ি চলে গেলেও বাকিরা ছিল। ওদের সাথেই আমরা বাঁকুড়া যাবো, রাতের চক্রধরপুর এক্সপ্রেসে।
সিন - ২ (বিকেল পাঁচটা - সাড়ে পাঁচটা) রাতের ট্রেন তাই খেয়েদেয়ে রওনা হব সবাই। সবার জন্য ভাত, একটি ডিম, চার টুকরো আলু ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় ঝোল। বাঘের বাচ্চার হাতে একটা থালা দিচ্ছে দেখে আমি ত্রাহি ত্রাহি রবে বলে উঠলাম - ওকে দিস না। এই মাত্র বত্রিশটা রুটি খেয়ে এসেছে। "তো? কখন খেয়েছি খেয়াল আছে? আর এই যে বাড়ি থেকে শিয়ালদহ, স্টেশন থেকে মেস, এতটা হেঁটে এলাম? সব হজম হয়ে গেছে। দে দে"। দিব্বি দুবার আরো ভাত নিয়ে পুরোটা খেয়ে একটা ঢেকুর তুললেন।
ভাবলাম ক্ষান্ত দিলো। হাওড়া স্টেশনে এসে সবাই এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করছিল। ট্রেন আসতেই আমি উঠে সিধা ঘুম। তবে নিন্দুকেরা বলে, সিন - ৩ তে কলা ও পাউরুটি ভালোই জমেছিল।
সিন - ৪ (ভোর সাড়ে চারটে - পাঁচটা) চক্রধরপুর এক্সপ্রেস খুব ভোরবেলা বাঁকুড়া পৌছাত। ভোরবেলা বিয়েবাড়িতে একদিকে দধিমঙ্গল চলছে আর আমরা দশ বারো জন ছাদে শতরঞ্চিতে বসে। দুধ-মুড়কি ও বোদে। ভোরবেলার সেই নির্মল খাওয়া, আজও আমার মুখে লেগে আছে। সবার খাওয়া হয়ে গেলেও, বাবু দেখি বোদের হাড়িটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন। কোনোমতে হাত চেপে ওখান থেকে টেনে তুলি তাকে।
কাকু (পলাশের বাবা) আমাদের থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন ওনাদের বাড়ি থেকে একটু দূরে, একটা ইরিগেসন বা পিডব্লুডি'র বাংলোয়। একটু দূরেই একটা ঝিল। ভারী মনোরম পরিবেশ। ভোরবেলা এসেই, যে যার মতো বিছানায়। এগারোটা নাগাদ ঘুম থেকে উঠে দেখি ঝিলে সাঁতার কাটতে যাবার তোড়জোড় চলছে কয়েকজনের। "বাঘের বাচ্চা"কে তৈরি হতে দেখেই প্রমাদ গুনলাম। এমনই এই, সাঁতার কেটে এলে না জানি কি করবে।
সিন - ৫ (দুপুর একটা - দেড়টা) বিয়েবাড়িতে গিয়ে মধ্যাহ্নভোজন। কাউকে অসন্মান না করেই বলছি, পলাশের কাছেও শুনেছি, বাঁকুড়ায় পাতে ভাত একটু বেশিই নেওয়া হয়। আমার বন্ধুপ্রবরটির খাওয়া কিন্তু ওখানকার সবাইও হাঁ করে তাকিয়ে দেখেছিল। ভাত, মাছের মাথা দিয়ে ডাল, ঝুরো আলুভাজা, দু রকম তরকারি, পাকা পোনা মাছের কালিয়া, চাটনি ও মিষ্টি। "বাঘের বাচ্চা" ও আরো দুএকজন বন্ধুর খাওয়া দেখে বাকিরা নিশ্চিত ছিলাম, দুপুরে কয়েকজন অভুক্ত থাকবেন।
অমন সাদর আপ্যায়ন ও পরিবেশনে উদরপূর্তি করে বাংলোয় ফিরে ভাতঘুম। সন্ধ্যেবেলা বিয়ে, ঠিক ছিল বিয়ে মিটলে ফার্স্ট ব্যাচে খেয়ে আমি ও "বাঘের বাচ্চা" ট্রেন ধরব। কিন্তু বাবু দেখি সন্ধ্যেবেলা অন্যমনস্ক। জিজ্ঞাসা করতে বলল, মেয়ের বাড়ি বলে কথা, আমার বোধহয় ফার্স্ট ব্যাচে খাওয়াটা ঠিক হবে না। তুই যা।
লোকশ্রুতি আছে যে শেষ পর্যন্ত রাতে খাসি কাটিয়ে আবার মাংস রান্না হয়। তবে তার জন্য নাকি উনি বা আর দুএকজন বন্ধুই শুধু দায়ী নয়।
আমি চলে এলেও বাকিরা পরদিন দুপুরে খেয়ে, বাসে করে দুর্গাপুর ও সেখান থেকে ট্রেনে কলকাতা এসেছিল। তবে একটু বাকি আছে।
বিয়ের পরদিন সকালের জলখাবার বাংলোয় পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। পর্যাপ্ত পরিমাণে লুচি, আলুরদম, এক টিন রসগোল্লার সাথে এক বড় হাড়ি মাংস। "বাঘের বাচ্চা" সবাইকে ঘুম থেকে ডেকে আগে জলখাবার খেয়ে নিতে বলেছিল। বাকিরা শুনলেও চারজন কর্নপাত না করে ল্যাদ খেয়ে ঘুমিয়ে ছিল। লোকশ্রুতি আছে, চারজন ঘুম থেকে উঠে জনপ্রতি চারটে করে লুচি, চার পিস করে আলু, দুটো করে রসগোল্লা ও মাংসের ঝোল পেয়েছিলো। এহেন কর্মকান্ডের পর দুপুরে মনে হয় অগ্রিম প্রস্তুতি নেয়ায় কোনো অঘটন ঘটে নি।
পলাশের দিদির বিয়েতে গিয়ে ওদের বাড়ির ও বাঁকুড়ার আপ্যায়ন ও আদর-যত্ন আজও যেমন স্মৃতিতে জেগে আছে, "বাঘের বাচ্চা"র সেই খাওয়াদাওয়া বন্ধুদের স্মৃতিতেও অমলিন।
©সুব্রত চৌধুরী
আমাদের সাথেই পড়ত পলাশ, বাঁকুড়ায় বাড়ি। ওর দিদির বিয়েতে সব বন্ধুদের নেমন্তন্ন। পলাশ ও অন্য বন্ধুরা এসে বাড়িতে বলায় ছাড়পত্র মিলল যাওয়ার। রবিবার বিয়ে, তাই শনিবার সকালেই ব্যাগ গুছিয়ে কলেজ, ওখান থেকে সোজা বাঁকুড়া যাওয়া হবে।
"বাঘের বাচ্চা" যাবে না। বিয়ের দুদিন বাদেই ছাত্র সংসদ নির্বাচনের মনোনয়ন জমার শেষ দিন। ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের দরুন প্রতিপক্ষ হলেও, আমরা অভিন্ন হৃদয় বন্ধু। শনিবার আবার বললাম। চল, তুই আর আমি না হয় ফার্স্ট ব্যাচে খেয়ে রাতের ট্রেনে চলে আসবো। মঙ্গলবার অবধি সময় আছে। হটাৎ বাবুর সুমতি হলো। বললো চল বাড়িতে, মা কে বলে ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে আসি। যাদবপুর স্টেশন থেকে ট্রেনে শিয়ালদহ, সেইখান থেকে হেঁটে অখিল মিস্ত্রি লেনের কাছে ওদের বাড়ি। একরাশ প্রশ্নবাণ সামলে কাকিমার থেকে ছাড়পত্র আদায় হলো। বললেন, খেয়ে রওনা হও।
সিন - ১ (দুপুর আড়াইটে) দুজনে পাশাপাশি বসেছি। কাকিমা থালায় আখের গুড় ও আলুর তরকারির সাথে খান দশেক করে রুটি দিয়ে আবার রুটি বানাতে গেলেন। আমার তো আঁতকে ওঠার জোগাড়। কাকিমাকে বলতে যাবো, পাশ থেকে, মুখে রুটি ঠুসে, বাবু বলে উঠলেন "উঃ উঃ, রেখে দে, আমি নিয়ে নেব"। দু-তিনটে রুটি খেয়ে আমি উঠে গেলেও "বাঘের বাচ্চা" গুনে গুনে বত্রিশটা (আজ্ঞে হ্যা, ৩২) রুটি খেলেন।
কাকিমাকে প্রনাম করে, হেঁটে শিয়ালদহ সাউথ। এবার গন্তব্য গড়িয়া, পলাশদের মেস। গড়িয়া স্টেশন থেকে হেঁটে, ধরুন ৮বি থেকে বেঙ্গল ল্যাম্প হবে। পলাশ বাড়ি চলে গেলেও বাকিরা ছিল। ওদের সাথেই আমরা বাঁকুড়া যাবো, রাতের চক্রধরপুর এক্সপ্রেসে।
সিন - ২ (বিকেল পাঁচটা - সাড়ে পাঁচটা) রাতের ট্রেন তাই খেয়েদেয়ে রওনা হব সবাই। সবার জন্য ভাত, একটি ডিম, চার টুকরো আলু ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় ঝোল। বাঘের বাচ্চার হাতে একটা থালা দিচ্ছে দেখে আমি ত্রাহি ত্রাহি রবে বলে উঠলাম - ওকে দিস না। এই মাত্র বত্রিশটা রুটি খেয়ে এসেছে। "তো? কখন খেয়েছি খেয়াল আছে? আর এই যে বাড়ি থেকে শিয়ালদহ, স্টেশন থেকে মেস, এতটা হেঁটে এলাম? সব হজম হয়ে গেছে। দে দে"। দিব্বি দুবার আরো ভাত নিয়ে পুরোটা খেয়ে একটা ঢেকুর তুললেন।
ভাবলাম ক্ষান্ত দিলো। হাওড়া স্টেশনে এসে সবাই এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করছিল। ট্রেন আসতেই আমি উঠে সিধা ঘুম। তবে নিন্দুকেরা বলে, সিন - ৩ তে কলা ও পাউরুটি ভালোই জমেছিল।
সিন - ৪ (ভোর সাড়ে চারটে - পাঁচটা) চক্রধরপুর এক্সপ্রেস খুব ভোরবেলা বাঁকুড়া পৌছাত। ভোরবেলা বিয়েবাড়িতে একদিকে দধিমঙ্গল চলছে আর আমরা দশ বারো জন ছাদে শতরঞ্চিতে বসে। দুধ-মুড়কি ও বোদে। ভোরবেলার সেই নির্মল খাওয়া, আজও আমার মুখে লেগে আছে। সবার খাওয়া হয়ে গেলেও, বাবু দেখি বোদের হাড়িটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন। কোনোমতে হাত চেপে ওখান থেকে টেনে তুলি তাকে।
কাকু (পলাশের বাবা) আমাদের থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন ওনাদের বাড়ি থেকে একটু দূরে, একটা ইরিগেসন বা পিডব্লুডি'র বাংলোয়। একটু দূরেই একটা ঝিল। ভারী মনোরম পরিবেশ। ভোরবেলা এসেই, যে যার মতো বিছানায়। এগারোটা নাগাদ ঘুম থেকে উঠে দেখি ঝিলে সাঁতার কাটতে যাবার তোড়জোড় চলছে কয়েকজনের। "বাঘের বাচ্চা"কে তৈরি হতে দেখেই প্রমাদ গুনলাম। এমনই এই, সাঁতার কেটে এলে না জানি কি করবে।
সিন - ৫ (দুপুর একটা - দেড়টা) বিয়েবাড়িতে গিয়ে মধ্যাহ্নভোজন। কাউকে অসন্মান না করেই বলছি, পলাশের কাছেও শুনেছি, বাঁকুড়ায় পাতে ভাত একটু বেশিই নেওয়া হয়। আমার বন্ধুপ্রবরটির খাওয়া কিন্তু ওখানকার সবাইও হাঁ করে তাকিয়ে দেখেছিল। ভাত, মাছের মাথা দিয়ে ডাল, ঝুরো আলুভাজা, দু রকম তরকারি, পাকা পোনা মাছের কালিয়া, চাটনি ও মিষ্টি। "বাঘের বাচ্চা" ও আরো দুএকজন বন্ধুর খাওয়া দেখে বাকিরা নিশ্চিত ছিলাম, দুপুরে কয়েকজন অভুক্ত থাকবেন।
অমন সাদর আপ্যায়ন ও পরিবেশনে উদরপূর্তি করে বাংলোয় ফিরে ভাতঘুম। সন্ধ্যেবেলা বিয়ে, ঠিক ছিল বিয়ে মিটলে ফার্স্ট ব্যাচে খেয়ে আমি ও "বাঘের বাচ্চা" ট্রেন ধরব। কিন্তু বাবু দেখি সন্ধ্যেবেলা অন্যমনস্ক। জিজ্ঞাসা করতে বলল, মেয়ের বাড়ি বলে কথা, আমার বোধহয় ফার্স্ট ব্যাচে খাওয়াটা ঠিক হবে না। তুই যা।
লোকশ্রুতি আছে যে শেষ পর্যন্ত রাতে খাসি কাটিয়ে আবার মাংস রান্না হয়। তবে তার জন্য নাকি উনি বা আর দুএকজন বন্ধুই শুধু দায়ী নয়।
আমি চলে এলেও বাকিরা পরদিন দুপুরে খেয়ে, বাসে করে দুর্গাপুর ও সেখান থেকে ট্রেনে কলকাতা এসেছিল। তবে একটু বাকি আছে।
বিয়ের পরদিন সকালের জলখাবার বাংলোয় পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। পর্যাপ্ত পরিমাণে লুচি, আলুরদম, এক টিন রসগোল্লার সাথে এক বড় হাড়ি মাংস। "বাঘের বাচ্চা" সবাইকে ঘুম থেকে ডেকে আগে জলখাবার খেয়ে নিতে বলেছিল। বাকিরা শুনলেও চারজন কর্নপাত না করে ল্যাদ খেয়ে ঘুমিয়ে ছিল। লোকশ্রুতি আছে, চারজন ঘুম থেকে উঠে জনপ্রতি চারটে করে লুচি, চার পিস করে আলু, দুটো করে রসগোল্লা ও মাংসের ঝোল পেয়েছিলো। এহেন কর্মকান্ডের পর দুপুরে মনে হয় অগ্রিম প্রস্তুতি নেয়ায় কোনো অঘটন ঘটে নি।
পলাশের দিদির বিয়েতে গিয়ে ওদের বাড়ির ও বাঁকুড়ার আপ্যায়ন ও আদর-যত্ন আজও যেমন স্মৃতিতে জেগে আছে, "বাঘের বাচ্চা"র সেই খাওয়াদাওয়া বন্ধুদের স্মৃতিতেও অমলিন।
©সুব্রত চৌধুরী
Comments
Post a Comment