ইলিশ ভাপে।
২০০৬ সালের জুন-জুলাই। হলদিয়ায় টাটা স্টিলের হুগলি মেট কোক প্রজেক্ট।
হলদিয়ার বন্ধ হয়ে যাওয়া হিন্দুস্থান ফার্টিলাইজার কোম্পানির (HFC) খালি জমিতে তৈরি হয়েছে হুগলি মেট কোক। তখন সবে প্রজেক্ট শুরু। প্রজেক্টের জন্য HFC র মেন গেট না ব্যবহার করে, পাতিখালীর দিক থেকে একটা এন্ট্রি গেট বানানো হয়েছিল। প্রজেক্টের ওপর সীমানা হলদি নদীর পাড়।
ব্যাচেলর ইঞ্জিনিয়ারদের জন্য প্রজেক্টই ঘর-বাড়ি হয়ে যায়, যদি মনমতো সাথী জুটে যায় তাহলে তো কথাই নেই। আমি ও ব্যতিক্রমী ছিলাম না। ওই প্রজেক্টেই আলাপ হয়েছিল "বানু"র সাথে। "বানু" নামটা আমারই দেওয়া। রান্নার হাতটা দারুন ছিল বানু'র। কুক না থাকলে মাঝেমধ্যে বানু'ই রান্না করে খাওয়াতো।
একদিন সকাল থেকে বৃষ্টি পড়েই চলেছে। মাঝে মধ্যে মুষলধারে, বাকি সময় ইলশেগুঁড়ি। সাইটের কাজ-কম্ম শিকেয়। হটাৎ বানু'কে বললাম চলো একটু ঘুরে আসি। দুজনে রেনকোট চাপিয়ে হাটতে হাটতে সাইটের শেষ মাথায় চলে এসেছি। হটাৎ বানু'র মাথায় এলো, শেষ সীমানায় হলদি নদীর দিকেও তো একটা গেট আছে, ওটা দিয়ে বেরোলেই তো নদীর পাড়। সিকিউরিটি কে বলে, ওই গেট খুলে, নদীর পাড়ে। ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টিতে নদীর সৌন্দর্য যেন কয়েকগুন বেড়ে গেছে।
আমাদের দুজনকে পাড় বরাবর হাঁটতে দেখে দূর হতে একটা নৌকা আমাদের দিকে এগিয়ে এলো। কাছাকাছি এসে মাঝবয়েসী একটা ছেলে নৌকা থেকেই আমায় বললো - দাদা, ইলিশ নেবেন। একদম তাজা। বড় ইলিশ আছে কিনা বলতেই দেখি, তিন খানা বড় বড় ইলিশ বার করেছে। প্রত্যেকটাই আন্দাজ দেড় কিলোর আশেপাশে। তিনটে কত জিজ্ঞেস করতেই বানু দেখি কটমট করে আমার দিকে তাকাচ্ছে। বললাম - রাগ করো না, সিনিয়ার ও জুনিয়র গেস্ট হাউসে একটা একটা বেঁচে দেব, তোমাকে ওতো রাঁধতে হবে না।
আবার জিগাই, তিনটে কত? মাঝি বলে, জানেনই তো দাদা, পাতিখালীর আড়ৎএ এর দাম কত উঠবে। সব টাকা মহাজনে খেয়ে যায়, আমরা কি পাই বলুন?
তিনটের জন্য তুমি কত নেবে বল?
৮০০ টাকা।
দর করিনি আর। কানকোতে ছেড়া জালের সূতো দিয়ে বেঁধে দিলো। আমিও দিব্যি গোপাল ভাঁড় মার্কা স্টাইলে (শুধু মাছ দোলানোর স্টাইল বলছি, পরিধানের কথা নয়) মাছ নিয়ে গেটে আসতেই সিকিউরিটি ছেকে ধরল। সবাইকে নৌকো দেখিয়ে বুঝলাম বেশি "গোপাল" হলে কেস গন্ডগোল, বাকিদের জবাবদিহি করতে করতেই জান বেরিয়ে যাবে। রেনকোটের ভিতরে মাছসহ হাত ঢুকিয়ে দুজনে সোজা অফিস। সিনিয়রদের ৫০০ টাকায় ও জুনিয়রদের ৩০০ টাকায় দুখানা দিয়ে আমি আর বানু ধাহ। ফ্রি'র ইলিশ, ঝোল ও ভাপে, যা রেঁধেছিল বানু, মহারানীর সাথে হয়ত ভালোই পাল্লা দিতে পারত।
এই রবিবার বরোদা থেকে আনা ইলিশটা বার করতে করতে মহারানীকে এই গল্পটা বলছিলাম। শুনতে শুনতে হটাৎ দেখি মহারানীর মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল "ওতো ছবি তোলার কি হয়েছে, শুনি?" ভাপার জন্য রাখা তিন পিসের ছবি তুলছিলাম।
কি হলো, কিছুই বুঝতে পারলাম না। রান্নার একটা ছবিও তুলতে দিল না। দুপুরে খেতে বসেও দেখি মুখটা বাংলার পাঁচ। ইলিশ ভাপে পাতে দিয়ে বলল - "খেয়ে দেখো, তোমার পীরিতের "বানু" না আমি, কার রান্না ভালো?"
খাবো কি? আমি তো হাসতে হাসতে চেয়ার ছেড়ে মাটিতে। "বানু" তো ব্যানার্জি। সিমপ্লেক্স কোম্পানিতে থাকাকালীন সুখ-দুঃখের সাথী, আমার রুমমেট সুদীপ্ত ব্যানার্জী। খাসা রান্নার হাত ছেলেটার।
©সুব্রত চৌধুরী
হলদিয়ার বন্ধ হয়ে যাওয়া হিন্দুস্থান ফার্টিলাইজার কোম্পানির (HFC) খালি জমিতে তৈরি হয়েছে হুগলি মেট কোক। তখন সবে প্রজেক্ট শুরু। প্রজেক্টের জন্য HFC র মেন গেট না ব্যবহার করে, পাতিখালীর দিক থেকে একটা এন্ট্রি গেট বানানো হয়েছিল। প্রজেক্টের ওপর সীমানা হলদি নদীর পাড়।
ব্যাচেলর ইঞ্জিনিয়ারদের জন্য প্রজেক্টই ঘর-বাড়ি হয়ে যায়, যদি মনমতো সাথী জুটে যায় তাহলে তো কথাই নেই। আমি ও ব্যতিক্রমী ছিলাম না। ওই প্রজেক্টেই আলাপ হয়েছিল "বানু"র সাথে। "বানু" নামটা আমারই দেওয়া। রান্নার হাতটা দারুন ছিল বানু'র। কুক না থাকলে মাঝেমধ্যে বানু'ই রান্না করে খাওয়াতো।
একদিন সকাল থেকে বৃষ্টি পড়েই চলেছে। মাঝে মধ্যে মুষলধারে, বাকি সময় ইলশেগুঁড়ি। সাইটের কাজ-কম্ম শিকেয়। হটাৎ বানু'কে বললাম চলো একটু ঘুরে আসি। দুজনে রেনকোট চাপিয়ে হাটতে হাটতে সাইটের শেষ মাথায় চলে এসেছি। হটাৎ বানু'র মাথায় এলো, শেষ সীমানায় হলদি নদীর দিকেও তো একটা গেট আছে, ওটা দিয়ে বেরোলেই তো নদীর পাড়। সিকিউরিটি কে বলে, ওই গেট খুলে, নদীর পাড়ে। ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টিতে নদীর সৌন্দর্য যেন কয়েকগুন বেড়ে গেছে।
আমাদের দুজনকে পাড় বরাবর হাঁটতে দেখে দূর হতে একটা নৌকা আমাদের দিকে এগিয়ে এলো। কাছাকাছি এসে মাঝবয়েসী একটা ছেলে নৌকা থেকেই আমায় বললো - দাদা, ইলিশ নেবেন। একদম তাজা। বড় ইলিশ আছে কিনা বলতেই দেখি, তিন খানা বড় বড় ইলিশ বার করেছে। প্রত্যেকটাই আন্দাজ দেড় কিলোর আশেপাশে। তিনটে কত জিজ্ঞেস করতেই বানু দেখি কটমট করে আমার দিকে তাকাচ্ছে। বললাম - রাগ করো না, সিনিয়ার ও জুনিয়র গেস্ট হাউসে একটা একটা বেঁচে দেব, তোমাকে ওতো রাঁধতে হবে না।
আবার জিগাই, তিনটে কত? মাঝি বলে, জানেনই তো দাদা, পাতিখালীর আড়ৎএ এর দাম কত উঠবে। সব টাকা মহাজনে খেয়ে যায়, আমরা কি পাই বলুন?
তিনটের জন্য তুমি কত নেবে বল?
৮০০ টাকা।
দর করিনি আর। কানকোতে ছেড়া জালের সূতো দিয়ে বেঁধে দিলো। আমিও দিব্যি গোপাল ভাঁড় মার্কা স্টাইলে (শুধু মাছ দোলানোর স্টাইল বলছি, পরিধানের কথা নয়) মাছ নিয়ে গেটে আসতেই সিকিউরিটি ছেকে ধরল। সবাইকে নৌকো দেখিয়ে বুঝলাম বেশি "গোপাল" হলে কেস গন্ডগোল, বাকিদের জবাবদিহি করতে করতেই জান বেরিয়ে যাবে। রেনকোটের ভিতরে মাছসহ হাত ঢুকিয়ে দুজনে সোজা অফিস। সিনিয়রদের ৫০০ টাকায় ও জুনিয়রদের ৩০০ টাকায় দুখানা দিয়ে আমি আর বানু ধাহ। ফ্রি'র ইলিশ, ঝোল ও ভাপে, যা রেঁধেছিল বানু, মহারানীর সাথে হয়ত ভালোই পাল্লা দিতে পারত।
এই রবিবার বরোদা থেকে আনা ইলিশটা বার করতে করতে মহারানীকে এই গল্পটা বলছিলাম। শুনতে শুনতে হটাৎ দেখি মহারানীর মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল "ওতো ছবি তোলার কি হয়েছে, শুনি?" ভাপার জন্য রাখা তিন পিসের ছবি তুলছিলাম।
কি হলো, কিছুই বুঝতে পারলাম না। রান্নার একটা ছবিও তুলতে দিল না। দুপুরে খেতে বসেও দেখি মুখটা বাংলার পাঁচ। ইলিশ ভাপে পাতে দিয়ে বলল - "খেয়ে দেখো, তোমার পীরিতের "বানু" না আমি, কার রান্না ভালো?"
খাবো কি? আমি তো হাসতে হাসতে চেয়ার ছেড়ে মাটিতে। "বানু" তো ব্যানার্জি। সিমপ্লেক্স কোম্পানিতে থাকাকালীন সুখ-দুঃখের সাথী, আমার রুমমেট সুদীপ্ত ব্যানার্জী। খাসা রান্নার হাত ছেলেটার।
©সুব্রত চৌধুরী
Comments
Post a Comment