টিউশন, ইনফ্যাচুয়েশন ও বিজয়ার এসিমিলেশন
মুখচোরা বা লাজুক না হলেও সুদীপ বরাবরই প্রেম-ট্রেম থেকে শত হস্ত দূরে থেকেছে পুরো স্কুল লাইফে। ইংলিশ মিডিয়াম কো-এড স্কুলে পড়লেও হই-হুল্লোড় করেই স্কুল লাইফটা কাটিয়েছে। শুধু সহপাঠীদের সাথে না, সহপাঠিনীদের সাথেও সুদীপের একটা আলাদা বন্ডিং ছিল। হাসি ঠাট্টা, হই-হুল্লোড়, খেলাধুলা বাদে পড়াশোনায় একটাই বিষয় জানত সে, ভৌতবিজ্ঞান। স্কুলের পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোলে রিপোর্ট কার্ড খুলে শুধু নিজের ও ভৌতবিজ্ঞানের হায়েস্ট মার্কসটা মিলিয়ে রেখে দিত।
মাধ্যমিকের গন্ডি পেরোতে না পেরোতেই শুরু হয়ে গেল ইঁদুর দৌড়ে টিকে থাকার লড়াই। উচ্চমাধ্যমিকের প্রত্যেকটা বিষয়ের আলাদা টিউশন। কিছু কিছু তো মাধ্যমিকের রেজাল্ট বেরোনোর আগে থেকেই চালু হয়ে গেছে। বন্ধু বান্ধবী সহপাঠীদের অনেকে পড়া শুরুও করে দিয়েছিল। সুদীপের অবশ্য সে সবের বালাই ছিল না রেজাল্ট বেরোনোর আগে অবধি। ফুটবল ও ক্রিকেটের খেপ খেলে ফুরসৎ কোথায় সেই তিন মাসে। রেজাল্ট বেরোতেই বাপে নিয়ে গিয়ে ভরে দিল সেই কোচিং সেন্টারগুলোতে।
কেমিস্ট্রি কোচিং সেন্টারে প্রথম যেদিন সুদীপ পা দিলো বাবার সাথে, পড়াশোনার অবস্থা শুনে তো অবাক। প্রথম চ্যাপ্টারটা রেজাল্ট বেরোনোর আগেই স্যারের পড়ানো হয়ে গেছে বাকি ছাত্র-ছাত্রীদের। শুধু আর একটা মেয়ে নতুন এসেছে, তাই ওদের দুজনকে চারটে এক্সট্রা ক্লাস করিয়ে দেবে স্যার। সকালে আসতে হবে। কবে কবে আসতে হবে এক্সট্রা ক্লাসের জন্য, তাও বলে দিলো।
পরদিন সকালে নিজের প্রাণাধিক প্রিয় "স্ট্রিট ক্যাট" সাইকেল নিয়ে সবার আগেই হাজির। কাজের লোক কোচিং সেন্টারের দরজা খুলে বসতে বলল।
একটু বাদে আরেকটি মেয়ে এসে ঢুকলো ঘরে। কো-এড স্কুলে পড়া সুদীপের জীবনে কোনোদিন মেয়েদের সাথে কথা বলায় আড়ষ্টতা ছিল না। কিন্তু আজ যেন বিধি বাম। মেয়েটির সাথে কথাই বলতে পারলো না, ভ্যাবলার মতো বসে রইল। স্যার ঢুকতে সম্বিৎ ফিরলো দুজনের। সকালের এক্সট্রা ক্লাস ছাড়াও সপ্তাহে রেগুলার ক্লাস দুটো। পরদিন বিকেলের ক্লাসে এসে আরো অবাক হলো সুদীপ। নিজের স্কুলের সহপাঠীদের মধ্যে দেবাশীষ, সমরেশ, বিশ্বজিৎ, পিয়ালী, অপর্ণা, আদৃজা ও অমৃতা রেজাল্ট বেরোনোর আগে থেকেই এখানে পড়া শুরু করে দিয়েছে। দেবাশীষকে দেখে সুদীপের রাগ হওয়াটাই স্বাভাবিক। ক্লাসে, সুদীপ-দেবা-অরূপ-জয়-নয়ন, এরা ছিল পঞ্চপাণ্ডব। প্রিটেস্টের জীবনবিজ্ঞানের প্রশ্নপত্র হঠাৎ করে হাতে পেয়ে এদের সবাইকেই জেরক্স দিয়েছিলো সুদীপ। নয়ন আর্টস ও অরূপ আর জয় কমার্স নেবে ঠিক করেই রেখেছিল। যেমন দেবা আর ও নিজে সাইন্স। তাও কোচিংয়ের কথাটা একবারও বলেনি। এই বন্ধুত্বের নমুনা।
গতকাল সকালে যে মেয়েটি এক্সট্রা ক্লাসে এসেছিল, সে আজ স্যারের ঠিক বাঁপাশে বসেছে, আদৃজার পাশেই। স্যার সুদীপকে ঠিক নিজের মুখোমুখি বসতে বলল। আগের দিন পাশাপাশি বসায় ভালো করে দেখেনি, আজ দেখলো সুদীপ। ঘাড় অবধি চুল, অনেকটা বব-কাট যাকে বলে। প্রাণবন্ত, উচ্ছল, বাকি মেয়েদের পেয়ে মুখে খই ফুটছে। নাম পারমিতা রায়। ক্যালকাটা গার্লস এর ছাত্রী। সুদীপের দৃষ্টি গিয়ে আটকালো ডান চিবুকের কাছের তিলটাতে। পারফেক্ট বিউটি স্পট। কেমিস্ট্রির ক্লাসে সুদীপের হৃদয়ে নতুন রসায়ন সৃষ্টি হতে থাকে।
বাকি কোচিং কেটে মাঝে মধ্যে ক্রিকেট বা ফুটবল টুর্নামেন্ট খেলতে গেলেও কেমিস্ট্রি কোচিংয়ে কামাই করতো না সুদীপ। একবার শনিবার, আন্ডারহ্যান্ড ক্রিকেট টুর্নামেন্টের ফাইনাল। ফাইনালে জিতলে দেড়শো টাকা দেবে বলেছিলো ক্লাবটা, তাও যায়নি, কারণ কেমিস্ট্রি কোচিং।
এতকরেও কিছুতেই কথা বলা হয়ে ওঠে না সুদীপের। শরণাপন্ন হয় আদৃজার। আদৃজা ও সুদীপের একটা আলাদা বন্ডিং ছিল। আদৃজার দিদি ও সুদীপের দাদা ব্যাচমেট। স্কুলের এক্সট্রা ক্লাসের জন্য নির্দিষ্ট সময়ের আগেই আসতে হতো ওদের, দাদা-দিদির সাথে। একটা মিষ্টি বন্ধুত্ব থেকে সকলের অলক্ষে তা রূপ নিয়েছিল ভাই-বোনের সম্পর্কের। কারণ, না আদৃজার ভাই ছিল, না সুদীপের বোন। আদৃজা রাখি পড়াতো সুদীপকে, স্কুলের বাকিরা কেউ জানতো না যদিও ব্যাপারটা।
আদৃজা খবর দিল, পারমিতার বয়ফ্রেন্ড আছে বটে, তবে পারমিতা নিজে তাকে নিয়ে সিরিয়াস নয়। কিন্তু, এও বলে দিল, যা করার সুদীপকেই করতে হবে, ও ওকালতি করতে নারাজ। শুধু একটা টিপস দিল, মোগলাই পরোটা খেতে খুব ভালোবাসে।
হাতখরচ বাবদ তেমন কিছু আলাদা করে সুদীপ পায়নি কখনো। মধ্যবিত্ত বাঙালি ঘরে সাইকেল থাকলে আসা যাওয়ার জন্য ছেলেদের রিকশা বা অটো ভাড়াও জুটতো না কপালে। নিজে টুর্নামেন্ট খেলে জমানো পয়সা যা সম্বল, তার বেশিরভাগ খরচা হয়ে যায় সিগারেট ফুঁকতে। কি ভাবে কি করবে কিছুই ভেবে পায় না দামাল-দুরন্ত-চটপটে ছেলেটা।
পড়াশোনায় ফাঁকি দিলেও মাথাটা কাঁচা ছিল না। সেটা বুঝতে পেরে স্যারেরাও পরোক্ষ স্নেহ করতো সুদীপকে। অনেক কঠিন প্রশ্নের জবাব মুখে মুখেই সলভ করে দিতে পারত সে, আর তাই দেখে পারমিতাও যে কিছুটা ইমপ্রেসড, সেটা ভালোই বুঝত। কিন্তু বরফ ভাঙার কথা ভাবলেই সিটিয়ে যেত সুদীপ। দেখতে দেখতে দুর্গাপুজো এসে গেল ও কোচিংয়ে ছুটি।
পুজোর পর একে একে সব কোচিং খুলতে লাগলো। কেমিস্ট্রি স্যার ঘুরতে গেছিলেন, তাই সেটাই সবচাইতে পরে খুলবে। অঙ্কের কোচিংয়ের প্রতিম ওই কেমিস্ট্রি কোচিংয়ে পড়ত, তবে অন্য ব্যাচ। সোমবার সকাল আর বৃহস্পতিবার বিকেল। সুদীপদের বুধ ও শনি বিকেলে। শুক্রবার সকালে প্রতিম জানালো, কেমিস্ট্রি স্যার হেবি কিপ্টে, শুধু দুটো নিকুতির সাইজের রসগোল্লা খাইয়েছে বিজয়াতে।
শনিবার বিকেলে একই সাথে মাইনে দেওয়ার দিন ও বিজয়ার খাওয়া। স্যারের নির্দেশ ছিল, মাইনের টাকা খামে ভরে ও খামের উপরে নাম লিখে তা টেবিলের উপর রেখে দেওয়ার। সুদীপ পৌঁছে দেখলো সবাই খাম রেখে দিয়েছে, স্যারের আসতে দেরি আছে। এই সুযোগ। সবাইকে হতচকিত করে সব কটা খাম থেকে টাকা বার করে একটা বড় খামে খালি খাম ও টাকাগুলো ভরে, তিনশ টাকা বের করে নিল সুদীপ। র্যাঞ্চো'র খাতা মিশিয়ে দেওয়ার আইডিয়াটা বোধহয় আমির খান সুদীপের থেকেই নিয়েছিল।
স্যার আসতেই সুদীপ ঘোষণা করলো, সবার মাইনে একজায়গায় মিশিয়ে ওই খামে রেখে দিয়েছি। আর তিনশো টাকা ওখান থেকে নিয়েছি, বিজয়ার খাবার আনবো বলে। স্যার যত বলে, আরে আমি মিষ্টি এনে রেখেছি, সুদীপ নাছোড়বান্দা। বললো, আমি ঝাল কিছু নিয়ে আসি। সাইকেল নিয়ে দমদম স্টেশনের সামনে থেকে মোগলাই পরোটা নিয়ে হাজির। সাথে আলুর তরকারিটা, উফফ। স্বর্গীয় স্বাদ পুরো। বাংলা স্যালাড (কুচো শশা ও পেঁয়াজ) আর কাসুন্দি দিয়ে সে স্বাদ, আহা। মোগলাই পরোটা যে কারোর প্রেমের (অনু)ঘটক হতে পারে, এই ধারণাই ছিল না সুদীপের। পারমিতার মোগলাই খাওয়ার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল সুদীপ। কিন্তু পারমিতা প্রথম টুকরোটা মুখে দিয়েই সুদীপের দিকে যে ভাবে দেখলো, মুখে থাকা আলুর টুকরোটা একেবারেই গলা দিয়ে গলে গেল। বিজয়ীর হাসি নিয়ে বাকিটা খেতে খেতে দুজনেরই চোখাচুখি হলো বেশ কয়েকবার।
বিজয়ীর হাসি বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় নি। খাওয়াদাওয়ার পর, পড়া শেষ হতেই সুদীপকে দশ মিনিট বসতে বলে বাকিদের বিদায় দিলেন স্যার। সবাই বেরিয়ে যেতে অজানা ভয় গ্রাস করলো সুদীপকে। হিরো তো হল, এবার? পকেট হাতড়ে দেখলো একশ কুড়ি টাকা আছে। স্যার, সুদীপ বলে ডাকতেই সিধা স্যারের পায়ে ডাইভ। "ভুল হয়ে গেছে স্যার, তবে খরচ করে ফেলেছি টাকাটা। একশ টাকা রাখুন, বুধবার বাকি দুশো টাকাও দিয়ে দেব।"
সুদীপের অবাক হওয়া একটু বাকি ছিল। পাশে বসিয়ে স্যার বললেন "বত্রিশ বছর শিক্ষকতা করছি। স্কুলে ও কোচিংয়ে আমার ভয়ে বাঘে গরুতে এক ঘাটে জল খায়। সেই আমার সামনে এই কান্ডটা যখন ঘটিয়েছিস, তার কারণটাও আমি ঠিকই ধরেছি। তা এতটা ভালোবাসা যদি পড়ার পিছনেও দিস, তাহলে তোর জীবনটা বোধহয় আরেকটু ভালো হবে।"
"আর হ্যা, স্টেশনের সামনে মোগলাই পরোটা তো পঁয়ত্রিশ টাকা করে, এগারোটার দাম তো তিনশো পঁচাশি টাকা। এই নে বাকি পঁচাশি টাকা।"
চোখের জলটা কোনোমতেই আর আটকাতে পারলো না সুদীপ। ঢিপ করে স্যারকে একটা প্রনাম করে বেরোতে যাবে, শুনতে পেল "উচ্চমাধ্যমিকে কেমিস্ট্রিতে লেটার চাই আমার। আর ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি, তোর মনোবাঞ্ছা পূরণ হোক। ভালো থাক, সুখে থাক তোরা।"
কিন্তু, অদৃষ্টের লেখা ................. (চলবে)
© সুব্রত চৌধুরী
ছবি © www.moha-mushkil.com
Disclaimer - The incidents and characters are a work of fiction and Resemblance to any person is purely coincidental.
মাধ্যমিকের গন্ডি পেরোতে না পেরোতেই শুরু হয়ে গেল ইঁদুর দৌড়ে টিকে থাকার লড়াই। উচ্চমাধ্যমিকের প্রত্যেকটা বিষয়ের আলাদা টিউশন। কিছু কিছু তো মাধ্যমিকের রেজাল্ট বেরোনোর আগে থেকেই চালু হয়ে গেছে। বন্ধু বান্ধবী সহপাঠীদের অনেকে পড়া শুরুও করে দিয়েছিল। সুদীপের অবশ্য সে সবের বালাই ছিল না রেজাল্ট বেরোনোর আগে অবধি। ফুটবল ও ক্রিকেটের খেপ খেলে ফুরসৎ কোথায় সেই তিন মাসে। রেজাল্ট বেরোতেই বাপে নিয়ে গিয়ে ভরে দিল সেই কোচিং সেন্টারগুলোতে।
কেমিস্ট্রি কোচিং সেন্টারে প্রথম যেদিন সুদীপ পা দিলো বাবার সাথে, পড়াশোনার অবস্থা শুনে তো অবাক। প্রথম চ্যাপ্টারটা রেজাল্ট বেরোনোর আগেই স্যারের পড়ানো হয়ে গেছে বাকি ছাত্র-ছাত্রীদের। শুধু আর একটা মেয়ে নতুন এসেছে, তাই ওদের দুজনকে চারটে এক্সট্রা ক্লাস করিয়ে দেবে স্যার। সকালে আসতে হবে। কবে কবে আসতে হবে এক্সট্রা ক্লাসের জন্য, তাও বলে দিলো।
পরদিন সকালে নিজের প্রাণাধিক প্রিয় "স্ট্রিট ক্যাট" সাইকেল নিয়ে সবার আগেই হাজির। কাজের লোক কোচিং সেন্টারের দরজা খুলে বসতে বলল।
একটু বাদে আরেকটি মেয়ে এসে ঢুকলো ঘরে। কো-এড স্কুলে পড়া সুদীপের জীবনে কোনোদিন মেয়েদের সাথে কথা বলায় আড়ষ্টতা ছিল না। কিন্তু আজ যেন বিধি বাম। মেয়েটির সাথে কথাই বলতে পারলো না, ভ্যাবলার মতো বসে রইল। স্যার ঢুকতে সম্বিৎ ফিরলো দুজনের। সকালের এক্সট্রা ক্লাস ছাড়াও সপ্তাহে রেগুলার ক্লাস দুটো। পরদিন বিকেলের ক্লাসে এসে আরো অবাক হলো সুদীপ। নিজের স্কুলের সহপাঠীদের মধ্যে দেবাশীষ, সমরেশ, বিশ্বজিৎ, পিয়ালী, অপর্ণা, আদৃজা ও অমৃতা রেজাল্ট বেরোনোর আগে থেকেই এখানে পড়া শুরু করে দিয়েছে। দেবাশীষকে দেখে সুদীপের রাগ হওয়াটাই স্বাভাবিক। ক্লাসে, সুদীপ-দেবা-অরূপ-জয়-নয়ন, এরা ছিল পঞ্চপাণ্ডব। প্রিটেস্টের জীবনবিজ্ঞানের প্রশ্নপত্র হঠাৎ করে হাতে পেয়ে এদের সবাইকেই জেরক্স দিয়েছিলো সুদীপ। নয়ন আর্টস ও অরূপ আর জয় কমার্স নেবে ঠিক করেই রেখেছিল। যেমন দেবা আর ও নিজে সাইন্স। তাও কোচিংয়ের কথাটা একবারও বলেনি। এই বন্ধুত্বের নমুনা।
গতকাল সকালে যে মেয়েটি এক্সট্রা ক্লাসে এসেছিল, সে আজ স্যারের ঠিক বাঁপাশে বসেছে, আদৃজার পাশেই। স্যার সুদীপকে ঠিক নিজের মুখোমুখি বসতে বলল। আগের দিন পাশাপাশি বসায় ভালো করে দেখেনি, আজ দেখলো সুদীপ। ঘাড় অবধি চুল, অনেকটা বব-কাট যাকে বলে। প্রাণবন্ত, উচ্ছল, বাকি মেয়েদের পেয়ে মুখে খই ফুটছে। নাম পারমিতা রায়। ক্যালকাটা গার্লস এর ছাত্রী। সুদীপের দৃষ্টি গিয়ে আটকালো ডান চিবুকের কাছের তিলটাতে। পারফেক্ট বিউটি স্পট। কেমিস্ট্রির ক্লাসে সুদীপের হৃদয়ে নতুন রসায়ন সৃষ্টি হতে থাকে।
বাকি কোচিং কেটে মাঝে মধ্যে ক্রিকেট বা ফুটবল টুর্নামেন্ট খেলতে গেলেও কেমিস্ট্রি কোচিংয়ে কামাই করতো না সুদীপ। একবার শনিবার, আন্ডারহ্যান্ড ক্রিকেট টুর্নামেন্টের ফাইনাল। ফাইনালে জিতলে দেড়শো টাকা দেবে বলেছিলো ক্লাবটা, তাও যায়নি, কারণ কেমিস্ট্রি কোচিং।
এতকরেও কিছুতেই কথা বলা হয়ে ওঠে না সুদীপের। শরণাপন্ন হয় আদৃজার। আদৃজা ও সুদীপের একটা আলাদা বন্ডিং ছিল। আদৃজার দিদি ও সুদীপের দাদা ব্যাচমেট। স্কুলের এক্সট্রা ক্লাসের জন্য নির্দিষ্ট সময়ের আগেই আসতে হতো ওদের, দাদা-দিদির সাথে। একটা মিষ্টি বন্ধুত্ব থেকে সকলের অলক্ষে তা রূপ নিয়েছিল ভাই-বোনের সম্পর্কের। কারণ, না আদৃজার ভাই ছিল, না সুদীপের বোন। আদৃজা রাখি পড়াতো সুদীপকে, স্কুলের বাকিরা কেউ জানতো না যদিও ব্যাপারটা।
আদৃজা খবর দিল, পারমিতার বয়ফ্রেন্ড আছে বটে, তবে পারমিতা নিজে তাকে নিয়ে সিরিয়াস নয়। কিন্তু, এও বলে দিল, যা করার সুদীপকেই করতে হবে, ও ওকালতি করতে নারাজ। শুধু একটা টিপস দিল, মোগলাই পরোটা খেতে খুব ভালোবাসে।
হাতখরচ বাবদ তেমন কিছু আলাদা করে সুদীপ পায়নি কখনো। মধ্যবিত্ত বাঙালি ঘরে সাইকেল থাকলে আসা যাওয়ার জন্য ছেলেদের রিকশা বা অটো ভাড়াও জুটতো না কপালে। নিজে টুর্নামেন্ট খেলে জমানো পয়সা যা সম্বল, তার বেশিরভাগ খরচা হয়ে যায় সিগারেট ফুঁকতে। কি ভাবে কি করবে কিছুই ভেবে পায় না দামাল-দুরন্ত-চটপটে ছেলেটা।
পড়াশোনায় ফাঁকি দিলেও মাথাটা কাঁচা ছিল না। সেটা বুঝতে পেরে স্যারেরাও পরোক্ষ স্নেহ করতো সুদীপকে। অনেক কঠিন প্রশ্নের জবাব মুখে মুখেই সলভ করে দিতে পারত সে, আর তাই দেখে পারমিতাও যে কিছুটা ইমপ্রেসড, সেটা ভালোই বুঝত। কিন্তু বরফ ভাঙার কথা ভাবলেই সিটিয়ে যেত সুদীপ। দেখতে দেখতে দুর্গাপুজো এসে গেল ও কোচিংয়ে ছুটি।
পুজোর পর একে একে সব কোচিং খুলতে লাগলো। কেমিস্ট্রি স্যার ঘুরতে গেছিলেন, তাই সেটাই সবচাইতে পরে খুলবে। অঙ্কের কোচিংয়ের প্রতিম ওই কেমিস্ট্রি কোচিংয়ে পড়ত, তবে অন্য ব্যাচ। সোমবার সকাল আর বৃহস্পতিবার বিকেল। সুদীপদের বুধ ও শনি বিকেলে। শুক্রবার সকালে প্রতিম জানালো, কেমিস্ট্রি স্যার হেবি কিপ্টে, শুধু দুটো নিকুতির সাইজের রসগোল্লা খাইয়েছে বিজয়াতে।
শনিবার বিকেলে একই সাথে মাইনে দেওয়ার দিন ও বিজয়ার খাওয়া। স্যারের নির্দেশ ছিল, মাইনের টাকা খামে ভরে ও খামের উপরে নাম লিখে তা টেবিলের উপর রেখে দেওয়ার। সুদীপ পৌঁছে দেখলো সবাই খাম রেখে দিয়েছে, স্যারের আসতে দেরি আছে। এই সুযোগ। সবাইকে হতচকিত করে সব কটা খাম থেকে টাকা বার করে একটা বড় খামে খালি খাম ও টাকাগুলো ভরে, তিনশ টাকা বের করে নিল সুদীপ। র্যাঞ্চো'র খাতা মিশিয়ে দেওয়ার আইডিয়াটা বোধহয় আমির খান সুদীপের থেকেই নিয়েছিল।
স্যার আসতেই সুদীপ ঘোষণা করলো, সবার মাইনে একজায়গায় মিশিয়ে ওই খামে রেখে দিয়েছি। আর তিনশো টাকা ওখান থেকে নিয়েছি, বিজয়ার খাবার আনবো বলে। স্যার যত বলে, আরে আমি মিষ্টি এনে রেখেছি, সুদীপ নাছোড়বান্দা। বললো, আমি ঝাল কিছু নিয়ে আসি। সাইকেল নিয়ে দমদম স্টেশনের সামনে থেকে মোগলাই পরোটা নিয়ে হাজির। সাথে আলুর তরকারিটা, উফফ। স্বর্গীয় স্বাদ পুরো। বাংলা স্যালাড (কুচো শশা ও পেঁয়াজ) আর কাসুন্দি দিয়ে সে স্বাদ, আহা। মোগলাই পরোটা যে কারোর প্রেমের (অনু)ঘটক হতে পারে, এই ধারণাই ছিল না সুদীপের। পারমিতার মোগলাই খাওয়ার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল সুদীপ। কিন্তু পারমিতা প্রথম টুকরোটা মুখে দিয়েই সুদীপের দিকে যে ভাবে দেখলো, মুখে থাকা আলুর টুকরোটা একেবারেই গলা দিয়ে গলে গেল। বিজয়ীর হাসি নিয়ে বাকিটা খেতে খেতে দুজনেরই চোখাচুখি হলো বেশ কয়েকবার।
বিজয়ীর হাসি বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় নি। খাওয়াদাওয়ার পর, পড়া শেষ হতেই সুদীপকে দশ মিনিট বসতে বলে বাকিদের বিদায় দিলেন স্যার। সবাই বেরিয়ে যেতে অজানা ভয় গ্রাস করলো সুদীপকে। হিরো তো হল, এবার? পকেট হাতড়ে দেখলো একশ কুড়ি টাকা আছে। স্যার, সুদীপ বলে ডাকতেই সিধা স্যারের পায়ে ডাইভ। "ভুল হয়ে গেছে স্যার, তবে খরচ করে ফেলেছি টাকাটা। একশ টাকা রাখুন, বুধবার বাকি দুশো টাকাও দিয়ে দেব।"
সুদীপের অবাক হওয়া একটু বাকি ছিল। পাশে বসিয়ে স্যার বললেন "বত্রিশ বছর শিক্ষকতা করছি। স্কুলে ও কোচিংয়ে আমার ভয়ে বাঘে গরুতে এক ঘাটে জল খায়। সেই আমার সামনে এই কান্ডটা যখন ঘটিয়েছিস, তার কারণটাও আমি ঠিকই ধরেছি। তা এতটা ভালোবাসা যদি পড়ার পিছনেও দিস, তাহলে তোর জীবনটা বোধহয় আরেকটু ভালো হবে।"
"আর হ্যা, স্টেশনের সামনে মোগলাই পরোটা তো পঁয়ত্রিশ টাকা করে, এগারোটার দাম তো তিনশো পঁচাশি টাকা। এই নে বাকি পঁচাশি টাকা।"
চোখের জলটা কোনোমতেই আর আটকাতে পারলো না সুদীপ। ঢিপ করে স্যারকে একটা প্রনাম করে বেরোতে যাবে, শুনতে পেল "উচ্চমাধ্যমিকে কেমিস্ট্রিতে লেটার চাই আমার। আর ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি, তোর মনোবাঞ্ছা পূরণ হোক। ভালো থাক, সুখে থাক তোরা।"
কিন্তু, অদৃষ্টের লেখা ................. (চলবে)
© সুব্রত চৌধুরী
ছবি © www.moha-mushkil.com
Disclaimer - The incidents and characters are a work of fiction and Resemblance to any person is purely coincidental.
Comments
Post a Comment