ডিমের ডেভিল ও মাছের লাল ঝোল

মামার বাড়ি ভারী মজা, সত্যিই খুব মজা ছিল। যাদের মামাবাড়ি একটু দূরে, বছরে একবার কি দুবারই যাওয়া হয়, তাদের জন্য তো একটু বেশিই মজা। আর যদি সেখানে নিজের চার মামা, এক মাসি, ছোট্ট শহরে ছড়িয়ে থাকে আরো তিন মামা, তিন মাসি, সেক্ষেত্রে বোধহয়, সোনায় সোহাগা। মা'র বক্তব্য অবশ্য - "আদরে বাঁদর"।
দাদুর মৃত্যুর বছর দেড়েক বাদে আমার জন্ম। তাই দিদার হিসেবে আমি ছিলাম "দাদু reincarnated"😀😀। ফলে, বুঝতেই পারছেন, মামাবাড়িতে আমার রাজ্যপাট কেমন চলত। মাহিশ্মতি সাম্রাজ্যে বাহুবলিও বাচ্চা তার কাছে।

তা বাহুবলি যখন এলো, কাটাপ্পাকে তো আসতেই হবে। কাটাপ্পা সত্যিই মামা, আমার বড়মামা। নির্ভেজাল খাদ্যরসিক। যেমন আমার পিতৃদেব, তেমনই আমার বড়মামা। বাজার করা ও খাওয়াদাওয়া, এই ব্যাপারে এনারা দুজনই আমার শিক্ষাগুরু / দীক্ষাগুরু।

বড়মামার ল্যাম্বি স্কুটারের সামনের জায়গাটায় দাঁড়িয়ে যাওয়া আমার জন্মগত অধিকার। জামশেদপুরের বাজার চেনার হাতে খড়ি এইভাবেই। শুধু বাজার কেন, যত রকমের ফাস্ট ফুড বা নাস্তার জায়গা আছে জামশেদপুরে, সবই চিনেছিলাম বড়মামার সাথে। এখনকার এসি দোকান কোনোটাই ছিল না, তবে বিস্টুপুরের ছাপ্পান ভোগের থেকেও ভালো ছিল সাকচির ভোলা মহারাজের ঘিয়ে ভাজা সিঙ্গাড়া। পেঁয়াজ রসুন ছাড়া। বা সাকচি বাজারের আটা চাক্কি'র সামনের আলু-টিকিয়া চাট। কেওয়াটের লিট্টি-চোখা। গৌরিশঙ্করের কচুরি-তরকারি। বেঙ্গল ক্লাবের গায়ে, আমবাগান ময়দানের সামনে আজকের "মিষ্টি"র ফাস্টফুড তখন জন্ম নেয়নি। গোলমুড়ি বাজারের ভিতরে একটা চপ-কাটলেটের দোকান ছিল। আমার ফেভারিট ছিলো ওই দোকানের ডিমের ডেভিল।

বছর পাঁচ কি ছয় আমার বয়স তখন। মামাবাড়ি পৌঁছানো মাত্র ছাড়া গরু। টিভি ছিল না মামাবাড়িতে। তাই খেলাধুলা, ঘুরে বেড়ানো ও খাওয়াদাওয়া, এই ছিল কাজ। সন্ধ্যে হলেই অপেক্ষা বড়মামার স্কুটারের আওয়াজের। অফিস থেকে ফিরলেই লগে লগে যেতে হবে সন্ধ্যের জন্য কিছু আনতে। সাথে উপরি, সেখানে দাঁড়িয়েই এক্সট্রা কিছু খেয়ে আসা। মামাবাড়িতে পৌঁছানো থেকে ফেরার আগের সন্ধ্যে অবধি, রোজ চলত আমার এই অত্যাচার। কেউ মানা করলেই, সিধা সুপ্রিম কোর্ট, মানে দিদার কাছে।

রোগা-প্যাটকা চেহারা হতে পারে, তবে আমার কিছু বন্ধুর মত আমারও "সরু পেটে গরু ধরে" কেস ছোটবেলা থেকেই শুরু। ভাজাভুজি, ফাস্টফুড ও খাসির মাংসের ক্ষেত্রে। সেইবার, গিয়ে থেকেই উত্তাল গিলে চলেছিলাম। পরেরদিন ভোরবেলা স্টিল এক্সপ্রেসে কলকাতা ফিরব, তাই সন্ধ্যেবেলা বড়মামাকে ভাজাভুজি আনতে মা বারণ করেছিল। আমি জানতে পেরে সটান সুপ্রিম কোর্ট থেকে (কেঁদেকেটে) পারমিশন জোগাড় করে স্কুটারের সামনে দাঁড়িয়ে। দোকানে গিয়ে ওখানেই দুটো ডেভিল পেটস্থ। ফিরে আরো টুক-টাক ভালোই চলেছিল।
গোল বাধলো পরেরদিন। মোটামুটি খড়গপুরের পর থেকে ট্রেনেই বমি চালু। বাড়ি ফিরে বমির সাথেই জলবৎ তরলং। বিকেলবেলা ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধের সাথে কাঁচকলা সেদ্ধ ও থানকুনি পাতা দিয়ে মাছের ঝোল, এই হলো ডায়েট প্ল্যান। টানা তিন বেলা (দেড়দিন) এই সুখাদ্য ও ওষুধ খেয়ে তৃতীয় বারেই আমি মোটামুটি অভক্তি প্রকাশ করা শুরু করে দিয়েছিলাম।
জিভের কোরক ও জ্ঞানের নাড়ি, আমার বরাবরই টনটনে। চতুর্থ বেলায়, বাবা অফিস, দাদা স্কুল, ঠাকুরমা পুজোয় ও মা রান্নাঘরে। আমি ঘুম থেকে উঠে গুটি গুটি পায়ে রান্নাঘরের সামনে আসতেই চক্ষু ছানাবড়া। "ওই তো লাল ঝোল" - এই ছিল আমার বিখ্যাত প্রতিক্রিয়া। তিন বেলা ধরে আমায় ভুজুং ভাজাং দিয়ে ওই হলুদ ঝোল গেলানো হয়েছে, "বাড়িতে নাকি ওইরকম মাছের ঝোলই সবাই খাচ্ছে", আর আমায় পায় কে? রান্নাঘরের চৌকাঠেই চিৎকার, চেঁচামেচি (আমার) ও (মায়ের) মাথাব্যথা। মা যত বলে, আচ্ছা চল, স্নান করে এসে খাবি, কিন্তু উহু -  ন্যাড়া একটু কেলিয়ে পড়েছিল বলে তিন বার বেলতলা ঘুরে এসেছে। আর নয়। চান করতে গেলে যদি আবার গায়েব হয়ে যায়? "নো তেলমাখা - নো জল - নো নাহানা, লাল ঝোল দিয়ে মেখে - ওন দা স্পট খানা।" শেষ অবধি আমি লাল ঝোল দিয়েই ভাত খাই ও মা আমার জন্য রাঁধা থানকুনি পাতা দেওয়া মাছের ঝোল।

©সুব্রত চৌধুরী
ছবি - ©Subhankar Ghosh

পুনঃ - আমি ব্রেনলিয়া খাই নি। আমার স্মৃতিশক্তির উপর ভরসা করে পুরোটা লেখা না। ঘটনাটি আমাদের বাড়িতে প্রায়ই আলোচনা হয়ে থাকে, তাই।



Comments

Popular posts from this blog

কার্তিক পুজো ও খাওয়াদাওয়া

পুজো ও বামুন

তালশাঁস সন্দেশ