টুকলি (পার্ট ২)
খটখট করছে রোদ। বৃষ্টি-বাদলা কিছুই হয়নি আগেরদিন, যে ভিজে গিয়ে ঠান্ডা লাগবে। তাও তার নাকি ঠান্ডা লেগেছে। হাজারবার নাক টানলেও নাকে একটুও আওয়াজ নেই, জল তো দুরঅস্ত, তবু নাকের জলে তার রুমাল ভিজে একসা। ব্যাপার কিছুই না, পরীক্ষায় খাতার সাপোর্টের জন্য আনা বোর্ডে সাদা কাগজ সাটিয়ে তাতে লেবুর রস দিয়ে লিখে এনেছে। ভিজে রুমাল বুলিয়ে টুকলি করবে। সে যাত্রায় ওই পদ্ধতিতে টুকলি করা অবশ্য হয়নি, সন্দেহ হওয়ায় বোর্ডটাই বাইরে রেখে আসতে হয়েছিল। কিন্তু তাতে তার কিছু যায় আসে না। কারণ একটি ব্রহ্মাস্ত্র সব সময় থাকত তার, যার বিস্তারিত বিবরণ পরে লিখছি।
পরীক্ষার হলে নবাব নন্দনের মতো পায়ের উপর পা তুলে বসে বাবু পরীক্ষা দিচ্ছে। তাহলেই বুঝে যেতাম, হেয়ার রিমুভার দিয়ে পায়ের গোড়ালি থেকে হাঁটু অবধি লোম তুলে তার উপর উত্তর লিখে এনে টুকলি চলছে। তবে এসব তার নিজের মতেই নিতান্ত ছিচকে চুরি। যেদিন তার খাটতে ইচ্ছা করতো না, তখন এইসব মামুলি পন্থা অবলম্বন করতো।
টুকলি কে রীতিমতো শিল্পের পর্যায় নিয়ে গেছিলো আমার বন্ধুটি। বেঞ্চে বা দেওয়ালে লিখে রেখে টুকলি করার মত পন্থায় সে মোটেও বিশ্বাস করতো না। তার সব কথা লিখতে গেলে উপন্যাস হয়ে যাবে। তাই গোটা তিনেক লিখছি।
পরীক্ষা দিতে দিতে কখনো হয়তো দেখলাম, টুক করে চশমা বদলে নিল। আসলে, নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে মাইক্রো জেরক্সের চল তেমন ছিল না। বন্ধুটির হাতের লেখা ছিল খুব সুন্দর। ছোট্ট ছোট্ট কাগজের টুকরোয় নিজের হাতে লিখে টুকলি বানিয়ে এনেছে। এতই খুদি খুদি লেখা, খালি চোখে - পরীক্ষার হলে - গার্ডের চোখ বাঁচিয়ে - একঝলকে পড়া অসম্ভব। তাহলে উপায়? একই রকম ফ্রেমের আরো একটা চশমা বানিয়ে শ্রীমান পকেটে রেখে দিয়েছিল, যার বাঁদিকের কাঁচটি আদতে মাগ্নিফায়িং গ্লাস ছিল। বাঁ হাতে চিট নিয়ে চোখের সামনে ধরে (যেন মাথাব্যথা করছে) টুকলি করে তা গিলে ফেলত।
নব্বইয়ের দশকে মধ্যবিত্ত শহুরে বাঙালির একটা সাপ্তাহিক কাজ ছিল রেশন দোকানে লাইন দেওয়া। বাকি কিছু না নিলেও চিনি (ও কেরোসিন) তুলে কার্ডটা জীবিত রাখতে হত। আমাদের ওদিকে রেশন দোকানে পাওয়া যেত একটা মেরী / মারী বিস্কুট। নামটা মনে পড়ছে না, তবে সাদা রঙের প্যাকেট ছিল, প্রতি প্যাকেটে গোটা ছয়-আটেক বিস্কুট। রেশন ডিলার নিজের প্রফিটের জন্য এগুলো রাখতো। মহাশয় মাধ্যমিকের প্রথম দিন পরীক্ষা দিতে এলেন, সাথে ডাক্তারের সার্টিফিকেট। পেটে অসুখ, আলসার না হাতির মাথা। তাই পরীক্ষা দিতে দিতে তাকে খেতে দিতে হবে। বিস্কুট, সিল প্যাক। আসলে রাত জেগে, খুব সাবধানে বিস্কুটের প্যাকেট খুলে প্রতিটা বিস্কুটের পিছনে পেন্সিল দিয়ে উত্তর লিখেছে। তারপর আবার প্যাকেটে ভরে মোমবাতির আগুনের তাপে প্যাকেট সিল করে নিয়ে এসেছিল। যে বিস্কুটের পিছনে লেখা উত্তর কমন, তা ধীরে ধীরে ও যেটা কমন নয়, সেই বিস্কুট তাড়াতাড়ি খেয়ে দিব্যি বাংলা পরীক্ষা দিয়েছিল।
তবে তার ব্রহ্মাস্ত্র বা ট্রেডমার্ক টুকলির পন্থাটি সে নিজে ছাড়া একমাত্র আমিই জানতাম। আমাকে গুরু বলে ডাকতো, (টুকলির গুরু নই) অংকের জন্য আমিই ছিলাম তার ত্রাতা। এই পদ্ধতিটা লিখে কতটা বোঝাতে পারবো জানিনা, তাও। ছোট্ট ডায়েরি দেখেছেন? পকেট ডায়েরি বা নোটবুক বলে অনেকে। রাতভোর বসে বসে পেন্সিল দিয়ে লেখা। দুটো বড় রাবার ব্যান্ড বা গার্ডার নিয়ে ল্যাসোর ফাঁস পড়াতো ডায়েরির মাঝের পাতার উপর দিয়ে। এমন ভাবে, যাতে উপর-নিচ দুদিক দিয়ে দুটো রাবার ব্যান্ড বেরিয়ে থাকে। ডান থাইয়ে সুতলি দিয়ে বাঁধত স্পঞ্জ। তারপর সেই রাবার ব্যান্ড দুটো নিচ থেকে পা গলিয়ে থাই অবধি নিয়ে আসতো, যাতে ডায়েরিটা থাইয়ে স্পঞ্জের উপর সেটে থাকে।
ফুল প্যান্টের পায়ের ভেতরের দিকে একটা সেলাই হয়। থাইয়ের কাছে ইঞ্চি পাঁচেক মত সেই সেলাইটা খুলে সেফটি পিন লাগিয়ে আসতো। পরীক্ষা শুরু হওয়ার আগে টুক করে সেফটি পিনটা খুলে দিতেই, ব্যাস। সেলাইয়ের জায়গাটা একটু ফাক করে বাঁ হাত দিয়ে আস্তে করে ডায়েরিটা টেনে টুকলি করাটা তো এবার জলভাত। গার্ড তাকালে শুধু ডায়েরিটা ছেড়ে দিলেই হলো, রাবার ব্যান্ডের ইলাস্টিকের জন্য সে যথাস্থানে ফিরে যাবে। স্পঞ্জে গিয়ে ধাক্কা খাওয়ায় আওয়াজ হবে না, কিন্তু ধাক্কার চোটে সেলাইয়ের জায়গার ফাঁকটা আর থাকবে না। প্যান্টের কাপড়টা যেটুকু উঁচু করা ছিল, ধাক্কায় নেমে গিয়ে নর্মাল।
©সুব্রত চৌধুরী (পদ্ধতির কপিরাইট নেওয়ার ধৃষ্টতা আমার নেই)
ছবি - উইকিপিডিয়া
পরীক্ষার হলে নবাব নন্দনের মতো পায়ের উপর পা তুলে বসে বাবু পরীক্ষা দিচ্ছে। তাহলেই বুঝে যেতাম, হেয়ার রিমুভার দিয়ে পায়ের গোড়ালি থেকে হাঁটু অবধি লোম তুলে তার উপর উত্তর লিখে এনে টুকলি চলছে। তবে এসব তার নিজের মতেই নিতান্ত ছিচকে চুরি। যেদিন তার খাটতে ইচ্ছা করতো না, তখন এইসব মামুলি পন্থা অবলম্বন করতো।
টুকলি কে রীতিমতো শিল্পের পর্যায় নিয়ে গেছিলো আমার বন্ধুটি। বেঞ্চে বা দেওয়ালে লিখে রেখে টুকলি করার মত পন্থায় সে মোটেও বিশ্বাস করতো না। তার সব কথা লিখতে গেলে উপন্যাস হয়ে যাবে। তাই গোটা তিনেক লিখছি।
পরীক্ষা দিতে দিতে কখনো হয়তো দেখলাম, টুক করে চশমা বদলে নিল। আসলে, নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে মাইক্রো জেরক্সের চল তেমন ছিল না। বন্ধুটির হাতের লেখা ছিল খুব সুন্দর। ছোট্ট ছোট্ট কাগজের টুকরোয় নিজের হাতে লিখে টুকলি বানিয়ে এনেছে। এতই খুদি খুদি লেখা, খালি চোখে - পরীক্ষার হলে - গার্ডের চোখ বাঁচিয়ে - একঝলকে পড়া অসম্ভব। তাহলে উপায়? একই রকম ফ্রেমের আরো একটা চশমা বানিয়ে শ্রীমান পকেটে রেখে দিয়েছিল, যার বাঁদিকের কাঁচটি আদতে মাগ্নিফায়িং গ্লাস ছিল। বাঁ হাতে চিট নিয়ে চোখের সামনে ধরে (যেন মাথাব্যথা করছে) টুকলি করে তা গিলে ফেলত।
নব্বইয়ের দশকে মধ্যবিত্ত শহুরে বাঙালির একটা সাপ্তাহিক কাজ ছিল রেশন দোকানে লাইন দেওয়া। বাকি কিছু না নিলেও চিনি (ও কেরোসিন) তুলে কার্ডটা জীবিত রাখতে হত। আমাদের ওদিকে রেশন দোকানে পাওয়া যেত একটা মেরী / মারী বিস্কুট। নামটা মনে পড়ছে না, তবে সাদা রঙের প্যাকেট ছিল, প্রতি প্যাকেটে গোটা ছয়-আটেক বিস্কুট। রেশন ডিলার নিজের প্রফিটের জন্য এগুলো রাখতো। মহাশয় মাধ্যমিকের প্রথম দিন পরীক্ষা দিতে এলেন, সাথে ডাক্তারের সার্টিফিকেট। পেটে অসুখ, আলসার না হাতির মাথা। তাই পরীক্ষা দিতে দিতে তাকে খেতে দিতে হবে। বিস্কুট, সিল প্যাক। আসলে রাত জেগে, খুব সাবধানে বিস্কুটের প্যাকেট খুলে প্রতিটা বিস্কুটের পিছনে পেন্সিল দিয়ে উত্তর লিখেছে। তারপর আবার প্যাকেটে ভরে মোমবাতির আগুনের তাপে প্যাকেট সিল করে নিয়ে এসেছিল। যে বিস্কুটের পিছনে লেখা উত্তর কমন, তা ধীরে ধীরে ও যেটা কমন নয়, সেই বিস্কুট তাড়াতাড়ি খেয়ে দিব্যি বাংলা পরীক্ষা দিয়েছিল।
তবে তার ব্রহ্মাস্ত্র বা ট্রেডমার্ক টুকলির পন্থাটি সে নিজে ছাড়া একমাত্র আমিই জানতাম। আমাকে গুরু বলে ডাকতো, (টুকলির গুরু নই) অংকের জন্য আমিই ছিলাম তার ত্রাতা। এই পদ্ধতিটা লিখে কতটা বোঝাতে পারবো জানিনা, তাও। ছোট্ট ডায়েরি দেখেছেন? পকেট ডায়েরি বা নোটবুক বলে অনেকে। রাতভোর বসে বসে পেন্সিল দিয়ে লেখা। দুটো বড় রাবার ব্যান্ড বা গার্ডার নিয়ে ল্যাসোর ফাঁস পড়াতো ডায়েরির মাঝের পাতার উপর দিয়ে। এমন ভাবে, যাতে উপর-নিচ দুদিক দিয়ে দুটো রাবার ব্যান্ড বেরিয়ে থাকে। ডান থাইয়ে সুতলি দিয়ে বাঁধত স্পঞ্জ। তারপর সেই রাবার ব্যান্ড দুটো নিচ থেকে পা গলিয়ে থাই অবধি নিয়ে আসতো, যাতে ডায়েরিটা থাইয়ে স্পঞ্জের উপর সেটে থাকে।
ফুল প্যান্টের পায়ের ভেতরের দিকে একটা সেলাই হয়। থাইয়ের কাছে ইঞ্চি পাঁচেক মত সেই সেলাইটা খুলে সেফটি পিন লাগিয়ে আসতো। পরীক্ষা শুরু হওয়ার আগে টুক করে সেফটি পিনটা খুলে দিতেই, ব্যাস। সেলাইয়ের জায়গাটা একটু ফাক করে বাঁ হাত দিয়ে আস্তে করে ডায়েরিটা টেনে টুকলি করাটা তো এবার জলভাত। গার্ড তাকালে শুধু ডায়েরিটা ছেড়ে দিলেই হলো, রাবার ব্যান্ডের ইলাস্টিকের জন্য সে যথাস্থানে ফিরে যাবে। স্পঞ্জে গিয়ে ধাক্কা খাওয়ায় আওয়াজ হবে না, কিন্তু ধাক্কার চোটে সেলাইয়ের জায়গার ফাঁকটা আর থাকবে না। প্যান্টের কাপড়টা যেটুকু উঁচু করা ছিল, ধাক্কায় নেমে গিয়ে নর্মাল।
©সুব্রত চৌধুরী (পদ্ধতির কপিরাইট নেওয়ার ধৃষ্টতা আমার নেই)
ছবি - উইকিপিডিয়া
Comments
Post a Comment