টুকলি ও মিষ্টি দই
বিখ্যাত (কুখ্যাত ও বলতে পারেন) মাধ্যমিক ব্যাচের পরীক্ষার্থী আমি। ১৯৯৪। দু বার অংক পরীক্ষা হয়েছিল আমাদের।
বন্ধুকে পরীক্ষায় উত্তর বলে দিয়ে তার কাছ থেকে অনেকেই খেয়েছেন হয়ত। তাই বলে উত্তর দেখানোর এক মাস বাদে বন্ধুর কাকিমা আপনাকে ডাব বা মিষ্টি দই খাইয়েছে কখনো? আমি খেয়েছি।
১৯৯৪ সালে মাধ্যমিকের দ্বিতীয়বার অংক পরীক্ষা দিতে একাই এসেছি। দমদম কিশোর ভারতী স্কুলে সিট পড়েছিল। স্কুলের গেট খোলেনি বলে বাইরে গাছতলায় দন্ডায়মান। হটাৎ এক ভদ্রমহিলা এসে নাম জিজ্ঞেস করলেন। কনফার্ম হতেই "আরে একা একা দাঁড়িয়ে আছো, এস এস। ডাব খাবে?" বলেই সটান একটা ডাব কাটিয়ে আমার হাতে। হারগিলে চেহারা হলে কি হবে, খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে আমার ধানাই পানাই কমই ছিল। ডাবের জল স্ট্র দিয়ে উদরস্থ করতে করতে শুনলাম "আচ্ছা বাবা, তুমি প্রথমবারের অংক পরীক্ষায় কত পাবে?"
এমন একটা প্রশ্নের জন্য ঠিক রেডি ছিলাম না। বিষম খেতে খেতেও কোনোক্রমে মুখ তুলে বললাম, "মানে? আপনি কে?"
বন্ধুর নাম বলে বললেন, আমি তার কাকিমা। ভালো কথা। তা হটাৎ এই প্রশ্ন?
"আহা বলোই না, তুমি যা পরীক্ষা দিয়েছিলে, তাতে কত পেতে পারো?"
কেন?
"তোমার বন্ধু বলছে, সে আর পরীক্ষা দেবে না। তোমার পাশেই বসেছিল তো, বলছে নাকি লেটার পাবে। তুমি কি সত্যিই নব্বইয়ের উপর আশা করো?"
হ্যা করি। ব্যাস এইটুকু বলতেই ডাবওয়ালার পিছন থেকে উদয় হলেন শ্রীমান।
"বললাম না, কেউ বিশ্বাসই করছো না। ও যদি নব্বইয়ের উপরে পায় তো আমি বিরাশির উপর পাবই। লাস্ট সাত-আট নম্বর শুধু টুকতে পারিনি।"
আমি ঠিক কেসটা বুঝে উঠতে পারছি না তখনও। দুজনের মুখের উপর আমার দৃষ্টি ঘোরাফেরা করছে।
ব্যাপারটা আন্দাজ করে ভদ্রমহিলা বললেন "না, মানে, ও আর দ্বিতীয়বার পরীক্ষা দেবে না বলছে। তাই শিওর হওয়ার জন্য আমি তোমায় জিজ্ঞেস করলাম।" বলেই নিজের হাতের প্লাস্টিক থেকে একটি একশ গ্রামের মিষ্টি দইয়ের ভাঁড় বার করে বললেন "এই নাও বাবা, একটু দই খাও। দই খেয়ে পরীক্ষা দিতে যাওয়া শুভ।"
দইয়ের ভাঁড়টা ছাড়িনি। হাতে নিয়ে বন্ধুকে বললাম "সে কি রে? পরীক্ষা দিবি না কেন? এবার তো সহজ প্রশ্নই আসবে।"
শ্রীমান মুচকি হেসে বললেন "যতই সহজ প্রশ্ন আসুক, ইনভিজিলেটাররা কি ছেড়ে দেবে ভেবেছিস? কি করেছিলাম ভুলে গেলি? হাতে মাথা কাটবে আমার।"
না ভুলিনি। আমৃত্যু ভুলব না।
টুকলি করার ইনোভেটিভ আইডিয়ার জন্য যদি কোন নোবেল থাকত, আমার বন্ধুটি বলে বলে প্রতি বছর তা দখলে রাখতে পারত। তার সব আইডিয়া লিখলে একটা পঞ্চাশ পাতার বই হয়ে যাবে এবং কোনো কোনো ছাত্রছাত্রীর বাইবেল হতে পারে। এখানে মাধ্যমিকেরই একটা নমুনা দিই। ভূগোল পরীক্ষার দিন হলে ঢোকার আগে আমার হাতে দেখি ভাঁজ করা রুমালটা দিচ্ছে। তাকাতেই বলল "গুরু, এটা রাখ্। তোর হয়ে গেলে আমায় পাস করে দিস।" খুলে দেখি সোল্ডারিং এর তার বেকিয়ে ছোট্ট একটা ভারতের ম্যাপ। চাল, তুলা বা গম ইত্যাদি চাষ / উৎপাদনের জায়গার জন্য পরীক্ষার খাতায় হাতে আঁকতে হতো তখন। যা হোক, আমার থেকে আরো এক-দু হাত ঘুরে তার হাতে যখন জিনিসটি পৌছালো, গার্ড বুঝলো কিছু একটা গড়বড় আছে। কাছে পৌঁছে তাকে যেই জিজ্ঞেস করেছে "এই এটা কি?" উনি সাথে সাথে সেটিকে হাতের চাপে মুড়িয়ে একটা জগাখিচুড়ি বানিয়ে দিয়ে বলেছিলো, "দেখুন, কি?"
সেই দিন থেকে তিনি কড়া নজরে ছিলেন। তবুও গার্ডদের সাথে লুকোচুরি খেলে ও নিজের আরো কিছু ইনোভেটিভ আইডিয়া দিয়ে ভালোই চালাচ্ছিলেন। গন্ডগোলটা হলো অংক পরীক্ষার দিন। অমন ঘোরানো অংকের প্রশ্নপত্র বোধহয় মাধ্যমিকের ইতিহাসে কমই এসেছিল।
ওনার আবার অংক জিনিসটা পুরোপুরি মুখস্ত বিদ্যার ভরসায় চলত। এমন ঘোরানো প্রশ্ন দেখে সবাই যারপরনাই মাথা চুলকাচ্ছি, সে তো সর্ষেফুল দেখছে। এক ঘণ্টার বেল পড়তেই দেখি টয়লেটের নাম করে বেরিয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ পরে, স্কুলে একটা ভয়ানক ব্যস্ততা লক্ষ্য করলাম। ইনভিজিলেটাররা উদ্বিগ্ন মুখে এদিক ওদিক দেখছে। মিনিট পাঁচেক পর দেখি, শ্রীমানের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে একজন শিক্ষিকা এনে আমার পাশে তাকে বসলেন। আমায় বললেন "বাবা, প্রশ্ন খুব কঠিন হয়েছে। ওকে একটু দেখিয়ো।"
ব্যাস, এইটা বলার দেরি ছিল বোধহয়। উনি সটান আমার মেন শিটটা নিয়ে বেমালুম লেখা শুরু করে দিলেন। মোটামুটি পুরো হলেই এর খাতা থেকে ও, তো তার খাতা থেকে সে দেখছে। পরীক্ষা শেষ হওয়ার আগে আমায় রীতিমত উঠে গিয়ে নিজের খাতা ও সাপ্লিমেন্টারি শিট খুঁজে আনতে হয়েছিল।
পরীক্ষার হল থেকে বেরিয়েই সবাই শ্রীমানকে পাকড়াও করল। "তুই কি এমন করেছিলি যে তোকে বাবা-বাছা করে এনে আমার পাশে বসিয়ে টুকতে দিলো? আর আমার পাশেই কেন?"
উত্তরে তার 'পরেরবারে হাতে মাথা কাটার' কারণ জানলাম।
টয়লেটের নাম করে বেরিয়ে সিধা সিঁড়ির মুখে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। দুজন শিক্ষক-শিক্ষিকাকে আসতে দেখেই - "এই প্রশ্নপত্রে উত্তর দেওয়া যায়? আমি আত্মহত্যা করব" বলে এক দৌড়ে ছাদে উঠে যায়। পিছন পিছন কিশোর ভারতী স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারা উঠে এলে তাদের ভয় দেখাতে থাকে ছাদ থেকে ঝাঁপ দেবে বলে। অনেক অনুনয় বিনয়ের পর তিনি এই শর্তেই ক্ষান্ত দিতে রাজি হন, তাকে আমার পাশে বসতে দিতে হবে।
এহেন "ভালো" পরীক্ষার্থীকে দ্বিতীয়বার পেলে ইনভিজিলেটাররা ভালোই খাতির-যত্ন করবেন, সেটা শ্রীমান বিলক্ষণ বুঝেছিল। তাই আর হল মুখো হয়নি।
© সুব্রত চৌধুরী।
ছবি - Sameer
বন্ধুকে পরীক্ষায় উত্তর বলে দিয়ে তার কাছ থেকে অনেকেই খেয়েছেন হয়ত। তাই বলে উত্তর দেখানোর এক মাস বাদে বন্ধুর কাকিমা আপনাকে ডাব বা মিষ্টি দই খাইয়েছে কখনো? আমি খেয়েছি।
১৯৯৪ সালে মাধ্যমিকের দ্বিতীয়বার অংক পরীক্ষা দিতে একাই এসেছি। দমদম কিশোর ভারতী স্কুলে সিট পড়েছিল। স্কুলের গেট খোলেনি বলে বাইরে গাছতলায় দন্ডায়মান। হটাৎ এক ভদ্রমহিলা এসে নাম জিজ্ঞেস করলেন। কনফার্ম হতেই "আরে একা একা দাঁড়িয়ে আছো, এস এস। ডাব খাবে?" বলেই সটান একটা ডাব কাটিয়ে আমার হাতে। হারগিলে চেহারা হলে কি হবে, খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে আমার ধানাই পানাই কমই ছিল। ডাবের জল স্ট্র দিয়ে উদরস্থ করতে করতে শুনলাম "আচ্ছা বাবা, তুমি প্রথমবারের অংক পরীক্ষায় কত পাবে?"
এমন একটা প্রশ্নের জন্য ঠিক রেডি ছিলাম না। বিষম খেতে খেতেও কোনোক্রমে মুখ তুলে বললাম, "মানে? আপনি কে?"
বন্ধুর নাম বলে বললেন, আমি তার কাকিমা। ভালো কথা। তা হটাৎ এই প্রশ্ন?
"আহা বলোই না, তুমি যা পরীক্ষা দিয়েছিলে, তাতে কত পেতে পারো?"
কেন?
"তোমার বন্ধু বলছে, সে আর পরীক্ষা দেবে না। তোমার পাশেই বসেছিল তো, বলছে নাকি লেটার পাবে। তুমি কি সত্যিই নব্বইয়ের উপর আশা করো?"
হ্যা করি। ব্যাস এইটুকু বলতেই ডাবওয়ালার পিছন থেকে উদয় হলেন শ্রীমান।
"বললাম না, কেউ বিশ্বাসই করছো না। ও যদি নব্বইয়ের উপরে পায় তো আমি বিরাশির উপর পাবই। লাস্ট সাত-আট নম্বর শুধু টুকতে পারিনি।"
আমি ঠিক কেসটা বুঝে উঠতে পারছি না তখনও। দুজনের মুখের উপর আমার দৃষ্টি ঘোরাফেরা করছে।
ব্যাপারটা আন্দাজ করে ভদ্রমহিলা বললেন "না, মানে, ও আর দ্বিতীয়বার পরীক্ষা দেবে না বলছে। তাই শিওর হওয়ার জন্য আমি তোমায় জিজ্ঞেস করলাম।" বলেই নিজের হাতের প্লাস্টিক থেকে একটি একশ গ্রামের মিষ্টি দইয়ের ভাঁড় বার করে বললেন "এই নাও বাবা, একটু দই খাও। দই খেয়ে পরীক্ষা দিতে যাওয়া শুভ।"
দইয়ের ভাঁড়টা ছাড়িনি। হাতে নিয়ে বন্ধুকে বললাম "সে কি রে? পরীক্ষা দিবি না কেন? এবার তো সহজ প্রশ্নই আসবে।"
শ্রীমান মুচকি হেসে বললেন "যতই সহজ প্রশ্ন আসুক, ইনভিজিলেটাররা কি ছেড়ে দেবে ভেবেছিস? কি করেছিলাম ভুলে গেলি? হাতে মাথা কাটবে আমার।"
না ভুলিনি। আমৃত্যু ভুলব না।
টুকলি করার ইনোভেটিভ আইডিয়ার জন্য যদি কোন নোবেল থাকত, আমার বন্ধুটি বলে বলে প্রতি বছর তা দখলে রাখতে পারত। তার সব আইডিয়া লিখলে একটা পঞ্চাশ পাতার বই হয়ে যাবে এবং কোনো কোনো ছাত্রছাত্রীর বাইবেল হতে পারে। এখানে মাধ্যমিকেরই একটা নমুনা দিই। ভূগোল পরীক্ষার দিন হলে ঢোকার আগে আমার হাতে দেখি ভাঁজ করা রুমালটা দিচ্ছে। তাকাতেই বলল "গুরু, এটা রাখ্। তোর হয়ে গেলে আমায় পাস করে দিস।" খুলে দেখি সোল্ডারিং এর তার বেকিয়ে ছোট্ট একটা ভারতের ম্যাপ। চাল, তুলা বা গম ইত্যাদি চাষ / উৎপাদনের জায়গার জন্য পরীক্ষার খাতায় হাতে আঁকতে হতো তখন। যা হোক, আমার থেকে আরো এক-দু হাত ঘুরে তার হাতে যখন জিনিসটি পৌছালো, গার্ড বুঝলো কিছু একটা গড়বড় আছে। কাছে পৌঁছে তাকে যেই জিজ্ঞেস করেছে "এই এটা কি?" উনি সাথে সাথে সেটিকে হাতের চাপে মুড়িয়ে একটা জগাখিচুড়ি বানিয়ে দিয়ে বলেছিলো, "দেখুন, কি?"
সেই দিন থেকে তিনি কড়া নজরে ছিলেন। তবুও গার্ডদের সাথে লুকোচুরি খেলে ও নিজের আরো কিছু ইনোভেটিভ আইডিয়া দিয়ে ভালোই চালাচ্ছিলেন। গন্ডগোলটা হলো অংক পরীক্ষার দিন। অমন ঘোরানো অংকের প্রশ্নপত্র বোধহয় মাধ্যমিকের ইতিহাসে কমই এসেছিল।
ওনার আবার অংক জিনিসটা পুরোপুরি মুখস্ত বিদ্যার ভরসায় চলত। এমন ঘোরানো প্রশ্ন দেখে সবাই যারপরনাই মাথা চুলকাচ্ছি, সে তো সর্ষেফুল দেখছে। এক ঘণ্টার বেল পড়তেই দেখি টয়লেটের নাম করে বেরিয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ পরে, স্কুলে একটা ভয়ানক ব্যস্ততা লক্ষ্য করলাম। ইনভিজিলেটাররা উদ্বিগ্ন মুখে এদিক ওদিক দেখছে। মিনিট পাঁচেক পর দেখি, শ্রীমানের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে একজন শিক্ষিকা এনে আমার পাশে তাকে বসলেন। আমায় বললেন "বাবা, প্রশ্ন খুব কঠিন হয়েছে। ওকে একটু দেখিয়ো।"
ব্যাস, এইটা বলার দেরি ছিল বোধহয়। উনি সটান আমার মেন শিটটা নিয়ে বেমালুম লেখা শুরু করে দিলেন। মোটামুটি পুরো হলেই এর খাতা থেকে ও, তো তার খাতা থেকে সে দেখছে। পরীক্ষা শেষ হওয়ার আগে আমায় রীতিমত উঠে গিয়ে নিজের খাতা ও সাপ্লিমেন্টারি শিট খুঁজে আনতে হয়েছিল।
পরীক্ষার হল থেকে বেরিয়েই সবাই শ্রীমানকে পাকড়াও করল। "তুই কি এমন করেছিলি যে তোকে বাবা-বাছা করে এনে আমার পাশে বসিয়ে টুকতে দিলো? আর আমার পাশেই কেন?"
উত্তরে তার 'পরেরবারে হাতে মাথা কাটার' কারণ জানলাম।
টয়লেটের নাম করে বেরিয়ে সিধা সিঁড়ির মুখে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। দুজন শিক্ষক-শিক্ষিকাকে আসতে দেখেই - "এই প্রশ্নপত্রে উত্তর দেওয়া যায়? আমি আত্মহত্যা করব" বলে এক দৌড়ে ছাদে উঠে যায়। পিছন পিছন কিশোর ভারতী স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারা উঠে এলে তাদের ভয় দেখাতে থাকে ছাদ থেকে ঝাঁপ দেবে বলে। অনেক অনুনয় বিনয়ের পর তিনি এই শর্তেই ক্ষান্ত দিতে রাজি হন, তাকে আমার পাশে বসতে দিতে হবে।
এহেন "ভালো" পরীক্ষার্থীকে দ্বিতীয়বার পেলে ইনভিজিলেটাররা ভালোই খাতির-যত্ন করবেন, সেটা শ্রীমান বিলক্ষণ বুঝেছিল। তাই আর হল মুখো হয়নি।
© সুব্রত চৌধুরী।
ছবি - Sameer
দারুণ 😀😁
ReplyDelete