আজগুবি গল্প

৬০'র দশকের মাঝামাঝি। লে-অফ করে কর্মী ছাটাইয়ের প্রতিবাদে ইউনিয়ন ধর্নায় বসায় কোম্পানি ও কড়া মনোভাব নিয়ে সাময়িক লক-আউট ঘোষণা করেছে। দু পক্ষই অনড়। কাঁদানে গ্যাসের শেল ফাটিয়েও আন্দোলনরত শ্রমিকদের গেট থেকে হটানো যায়নি। প্রায় এক মাস হতে চললো।

৩০'র দশকে বাগেরহাট, খুলনার বাড়ি থেকে পালিয়ে কলকাতা হয়ে সাবেক কালিমাটি এসেছিল এক যুবক। কারখানায় শ্রমিকের কাজ নিয়েছিল। জাতে ব্রাহ্মণ হলেও চিতার ধোঁয়া দেখে যজমানির জন্য দৌড়ানো ছিল ঘোরতর না-পসন্দ।

কিন্তু ভবিতব্য। কোম্পানির এক বড় সাহেব ছিলেন বাঙালি। হটাৎ একদিন রাস্তায় বাংলায় কথা বলতে শুনে, সেই সাহেবের বাবা যুবকটিকে নাম জিজ্ঞেস করেন। ভট্টাচার্য্য পদবি শুনেই নিজের বাড়ির সত্য-নারায়ন পুজোর জন্য পীড়াপীড়ি করতে লাগলেন। যজমানির কাজ তো বাবা দেশে পৈতে দিয়েই শিখিয়ে দিয়েছিল, কিন্তু তার নিজের নৈবেদ্য এর চাল-কলা ছাদা বাধায় উৎসাহ নেই। এদিকে বড় সাহেবের বাবা, মুখের উপর না বলতেও অসুবিধা। শেষ অবধি সেই সূত্রেই জামশেদপুরে যজমানি চালু হলো ও ধীরে ধীরে লোকমুখে প্রচার ও হলো।

৬০'র দশকের শুরুর দিকে আরেক বাঙালি সাহেব নিজের বাড়িতে একদিন নিয়ে আসলেন রাচীর মুক্তেশ্বর মন্দির ও আশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা "পাগলাবাবা" কে। সাধু "পাগলাবাবা" তখন দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন, কেউ জ্যোতিষ বা ভবিষ্যৎ জানতে চাইলেও নিজে কুষ্টির ছকের হিসাব করতে পারেন না। বললেন, এমন একজন কাউকে চাই, যে অল্প-বিস্তর কুষ্টির কাজ জানে। সে যদি আমার কথামত ছকের হিসাব করে দেয়, তবে আমি সবার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারি। ডাক পড়লো শ্রমিক-পুরোহিতের। পারদর্শিতা দেখে পাগলাবাবা নাম দিলেন "জ্যোতিষ-বাবা", সেই নামে যদিও তিনি একাই ডাকতেন। ৬০'র দশকে তখন তার ভরা সংসার। স্ত্রী, পাঁচ ছেলে-মেয়ে, এক ভাই, তিন বোন ও বিধবা মা।

কয়েক বছর পরেই সেই লে-অফ, ধর্না ও লক-আউট। দিন গড়িয়ে সপ্তাহ, সপ্তাহ থেকে মাস।শ্রমিকদের মনোবল আসতে আসতে কমতে শুরু করলেও ধর্না চলছিলোই। কিন্তু নিজের পেটের জ্বালার থেকেও বড় মনে হয় পরিবার ও সন্তানের ক্ষুধার্ত মুখ। অনেকেই তাই দেশে যায়, কেউ পরিবার রেখে আসতে, কেউ বা দু-মুঠো অন্নের খোঁজে। মাস খানেক হতে চলায় জ্যোতিষবাবাও বললেন অনেকদিন পাগলাবাবার সাথে দেখা হয় নি, একটু রাচী ঘুরে আসি।

মালিকপক্ষও বোধহয় এমনই একটা সুযোগ খুঁজছিল। বেশ কিছু লোকজন এদিক সেদিক চলে যাওয়ায় হটাৎ একদিন রাত্রি সাড়ে আটটার সময় মাইক নিয়ে শ্রমিক বস্তিতে ঘোষণা করল "কোম্পানি লে-অফ ও লক-আউট প্রত্যাহার করছে। কাল সকাল সাড়ে পাঁচটায় গেট খুলবে। ৬টার মধ্যে যে সকল শ্রমিক কারখানায় প্রবেশ করবে, তাদেরকেই শুধু কাজে বহাল করা হবে।"

ঘোষণা শুনে মাথায় বাজ পড়ল সবার। বাড়ির একমাত্র রোজগেরে, গতকাল সকালেই তো রাচী গেছেন। এই রাতে টেলিগ্রামও যাবে না। দুশ্চিন্তায় নাওয়া খাওয়া মাথায়, সবাই প্রহর গুনছে। স্ত্রী বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত মুক্তেশ্বরের মূর্তির সামনে প্রার্থনা করে চলেছেন। বিনিদ্র রজনী যখন রাতের তৃতীয় প্রহরের মাঝামাঝি, বাড়ির সদর দরজার কড়ায় আওয়াজ।

ভূত দেখার মতো সকলে চমকে দেখেন, বাড়ির মানুষ বাড়িতে। মুহুর্মুহু ধেয়ে আসা প্রশ্নবাণের সামনে স্মিত হাস‍্যে একটাই উত্তর, "আমার কারখানা খুলে গেছে, আমি রাচীতে থেকে কি করব? তাই চলে এলাম।"
শেষ অবধি ভোর পাঁচটায় কারখানার উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার পূর্বে, জলখাবার খেতে খেতে বললেন "রাত্রি সাড়ে আটটা নাগাদ আশ্রমে রাতের খাওয়ার তোড়জোড় চলছিল। হটাৎ পাগলাবাবার জরুরি তলব আমাকে। ডেকে বললেন, জ্যোতিষবাবা, এক্ষুনি রওনা হন। একজনকে দেখিয়ে বললেন ও সাইকেলে আপনাকে বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে দেবে। কাপড়চোপড় পরের বার এসে নেবেন, কাল বিলম্ব না করে রওনা হন। শেষ বাস পেয়ে যাবেন। আপনার কারখানা খুলে গেছে। ভোরের আগে আপনার সেখানে উপস্থিত থাকা একান্ত প্রয়োজনীয়। কোনো কথাতেই কর্ণপাত না করে পাগলাবাবা আমায় পাঠিয়ে দিলেন।"

গাঁজাখুরি আজগুবি লাগলো তো? কাল রাতে মহারানী যখন আমায় বললো "সকালে রাধাবল্লভী ও আলুরদম বানাবো" আমারও ঠিক এমনই মনে হয়েছিল। সকালে অবশ্য জলখাবারে এটা পেয়েছি।

পুনঃ - আগেই বলেছি আজগুবি গল্প। দয়া করে যুক্তিবাদী প্রশ্ন করে বিব্রত করবেন না কেউ।
© সুব্রত চৌধুরী


Comments

Popular posts from this blog

কার্তিক পুজো ও খাওয়াদাওয়া

পুজো ও বামুন

তালশাঁস সন্দেশ