আমাদের স্কুল
টালির চালে ঢাকা আমাদের পুরোনো স্কুলটা অনেক ভালো ছিল। ক্যালকাটা এয়ারপোর্ট ইংলিশ হাই স্কুল। টালির চালের তলায় ক্যানভাস কাপড়ের ফলস সিলিং। চুন-সুরকি দিয়ে গাঁথা ইটের মোটা দেওয়াল। ঘটাং ঘটাং করে ঘুরতে থাকা ডিসি মোটরের পাখাগুলোর তলায় বসতে ভারী আরাম।
কোনো স্কুলে সাতটা খেলার মাঠ শুনেছে কেউ? ছিল, আমাদের স্কুলে ছিল। কাঠের বিশাল মেইন গেটটা দিয়ে ঢুকলেই সোজা রাস্তার বা-হাতে ত্রিকোণ আকৃতির একটা মাঠ। যার পরেই ছিল প্রাইমারি সেকশন। নার্সারি থেকে ক্লাস থ্রি। রাস্তার ডানদিকে ছোট গেট ও তার পরেই অফিস ঘর। ফিরে আসব সেখানে, আগে ক্লাস ও মাঠগুলো ঘুরে নিই একবার। সোজা পিচের রাস্তাটা ধরে অফিসঘর (তৎসহ ক্লাসরুম) কে পেরিয়ে, প্রাইমারি সেকশনকে বাদিকে রেখে এগিয়ে গেলেই ডানদিকে আবার একটা মাঠ। মাঠের ওপর প্রান্তে প্রাইমারি সেকশনের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটা ক্লাসরুম, ক্লাস ফোর। তার পাশে দুটো ছোট তালাবন্দি ঘর ছিল, ভিতরে ভাঙা সাইকেল ও হাবিজাবি জিনিসে ভরা। রাস্তার শেষ প্রান্ত থেকে ডানদিকে ঘুরে ক্লাস ফোরকে ডান পাশে রেখে এগিয়ে গেলে সোজা ক্লাস ফাইভ। ফোর ও ফাইভের মাঝে আরো একটা মাঠ, তবে ছোট। ক্লাস ফাইভে ধাক্কা খেয়ে আবার ডানদিকে ঘুরলে ইটের রাস্তা। বর্ষাকালে জল-কাদায় যেন হারমোনিয়ামের রিড, কোন ইট কখন নড়ে উঠে কাদা ছিটকাবে, কেউ জানে না। সেই রাস্তা ধরে একটু এগোলে ছোট মাঠের পর ডানদিকে হিন্দি ক্লাসরুম ও ওয়ার্ক এডুকেশনের ঘর ও বামদিকে আরো একটা মাঠ। সেই মাঠের কোনায় ছিল পানীয় জলের জায়গা। ইটের রাস্তার শেষ মাথায় একসাথে চারটে ক্লাসরুম। প্রথমে এইট, তারপর সেভেন, সিক্স ও শেষে হিন্দি রুম, সামনে পিছনে দুদিকেই টানা বারান্দা। এই ক্লাসঘরগুলোর পিছনে একটা ছোট খেলার মাঠ। সামনের দিকে স্কুলের প্রধান খেলার মাঠ। ছুটির সময় ওই মাঠেই লাইন দিয়ে দাঁড়াতে হতো আমাদের। ক্লাস এইটের সামনে থেকে একটা ইটের রাস্তা নেমে চলে গেছে স্কুলের অফিসের দিকে, সোজা। কিছুটা এগিয়ে ডানদিকে একটা রাস্তা গেছে অফিস বিল্ডিংয়ের পিছন দিকে। ওঃ হ্যা, বলতে ভুলে গেছিলাম, ওই রাস্তার ডানদিকেও একটা খেলার মাঠ। তা সেই অফিস বিল্ডিংয়ের মধ্যে ছিল ক্লাস নাইন, টেন, হিন্দি রুম, টিচার্স স্টাফ রুম ও হেড মিস্ট্রেস রায় টিচারের রুম। ১৯৮৭-৮৮ সালে অবশ্য প্রাইমারি ক্লাস গুলো ভেঙে ক্লাস এইটের এর পিছনের খেলার মাঠে নতুন প্রাইমারি সেকশন বানানো হয়েছিল।
পাশেই তখনকার ক্যালকাটা এয়ারপোর্ট। মনে আছে, বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং প্রধানমন্ত্রী হয়ে প্রথমবার যখন কলকাতা এলেন, ১৯৮৯ সালে, আমরা স্কুলের পিছনের গেট দিয়ে বেরিয়ে সোজা এয়ারপোর্টের রানওয়ের পাশে তাকে স্বাগত জানাতে দাঁড়িয়েছিলাম। আলাদা ডোমেস্টিক টার্মিনালের তখন কোনো অস্তিত্ব ছিল না। যারা এখনকার কলকাতা এয়ারপোর্টই শুধু দেখেছেন তাদের জন্য জানাই MS DHONI সিনেমাতে ধোনি আগরতলার প্লেন মিস করার জন্য যে কলকাতা এয়ারপোর্ট দেখিয়েছে আমি তার কথা বলছি। ১৯৯১ সালে আমাদের সেই স্কুল ভেঙেই ওই তৎকালীন আধুনিক ডোমেস্টিক টার্মিনাল তৈরি হয়। সাতটা মাঠ ও সম্পূর্ন ভাবে ছড়িয়ে থাকা ক্লাসরুমের স্কুল ছেড়ে উঠে আসতে হয়েছিল একটা দোতলা বিল্ডিং ও একফালি মাঠ সহ একটি স্কুলবাড়িতে। যা আজও আছে এয়ারপোর্ট ২নং গেটের কাছে। স্কুলবাড়িটা তিনতলা হয়েছে। আমাদের সময়কার মাধ্যমিক স্কুল আজ উচ্চমাধ্যমিক স্কুল। তিন বছর সেই স্কুলেও কাটিয়েছি। মোমবাতির প্রজ্জলিত শিখা (আমাদের স্কুলের প্রতীক) আজও শতশত ছাত্রছাত্রীকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করে চলেছে। তবু কেন জানিনা, পুরোনো স্কুলটা আমায় বড্ড বেশি টানে।
অভিশাপ আমি বিশ্বাস করি না। কিন্তু এইভাবে কেউ উচ্ছেদ হলে মনে হয় উদ্বাস্তুদের দীর্ঘশ্বাস পড়ে। কয়েকদিন আগে জমজমাট আলোকসজ্জায় ঝলমলে কলকাতা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নেমে ভলভো বাস ধরতে গিয়ে অন্ধকারাচ্ছন্ন পোড়াবাড়ির মতো সেই ডোমেস্টিক টার্মিনালটাকে পড়ে থাকতে দেখে, সত্যিই মনে হল, হ্যা, দীর্ঘশ্বাস পড়ে।
© সুব্রত চৌধুরী
কোনো স্কুলে সাতটা খেলার মাঠ শুনেছে কেউ? ছিল, আমাদের স্কুলে ছিল। কাঠের বিশাল মেইন গেটটা দিয়ে ঢুকলেই সোজা রাস্তার বা-হাতে ত্রিকোণ আকৃতির একটা মাঠ। যার পরেই ছিল প্রাইমারি সেকশন। নার্সারি থেকে ক্লাস থ্রি। রাস্তার ডানদিকে ছোট গেট ও তার পরেই অফিস ঘর। ফিরে আসব সেখানে, আগে ক্লাস ও মাঠগুলো ঘুরে নিই একবার। সোজা পিচের রাস্তাটা ধরে অফিসঘর (তৎসহ ক্লাসরুম) কে পেরিয়ে, প্রাইমারি সেকশনকে বাদিকে রেখে এগিয়ে গেলেই ডানদিকে আবার একটা মাঠ। মাঠের ওপর প্রান্তে প্রাইমারি সেকশনের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটা ক্লাসরুম, ক্লাস ফোর। তার পাশে দুটো ছোট তালাবন্দি ঘর ছিল, ভিতরে ভাঙা সাইকেল ও হাবিজাবি জিনিসে ভরা। রাস্তার শেষ প্রান্ত থেকে ডানদিকে ঘুরে ক্লাস ফোরকে ডান পাশে রেখে এগিয়ে গেলে সোজা ক্লাস ফাইভ। ফোর ও ফাইভের মাঝে আরো একটা মাঠ, তবে ছোট। ক্লাস ফাইভে ধাক্কা খেয়ে আবার ডানদিকে ঘুরলে ইটের রাস্তা। বর্ষাকালে জল-কাদায় যেন হারমোনিয়ামের রিড, কোন ইট কখন নড়ে উঠে কাদা ছিটকাবে, কেউ জানে না। সেই রাস্তা ধরে একটু এগোলে ছোট মাঠের পর ডানদিকে হিন্দি ক্লাসরুম ও ওয়ার্ক এডুকেশনের ঘর ও বামদিকে আরো একটা মাঠ। সেই মাঠের কোনায় ছিল পানীয় জলের জায়গা। ইটের রাস্তার শেষ মাথায় একসাথে চারটে ক্লাসরুম। প্রথমে এইট, তারপর সেভেন, সিক্স ও শেষে হিন্দি রুম, সামনে পিছনে দুদিকেই টানা বারান্দা। এই ক্লাসঘরগুলোর পিছনে একটা ছোট খেলার মাঠ। সামনের দিকে স্কুলের প্রধান খেলার মাঠ। ছুটির সময় ওই মাঠেই লাইন দিয়ে দাঁড়াতে হতো আমাদের। ক্লাস এইটের সামনে থেকে একটা ইটের রাস্তা নেমে চলে গেছে স্কুলের অফিসের দিকে, সোজা। কিছুটা এগিয়ে ডানদিকে একটা রাস্তা গেছে অফিস বিল্ডিংয়ের পিছন দিকে। ওঃ হ্যা, বলতে ভুলে গেছিলাম, ওই রাস্তার ডানদিকেও একটা খেলার মাঠ। তা সেই অফিস বিল্ডিংয়ের মধ্যে ছিল ক্লাস নাইন, টেন, হিন্দি রুম, টিচার্স স্টাফ রুম ও হেড মিস্ট্রেস রায় টিচারের রুম। ১৯৮৭-৮৮ সালে অবশ্য প্রাইমারি ক্লাস গুলো ভেঙে ক্লাস এইটের এর পিছনের খেলার মাঠে নতুন প্রাইমারি সেকশন বানানো হয়েছিল।
পাশেই তখনকার ক্যালকাটা এয়ারপোর্ট। মনে আছে, বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং প্রধানমন্ত্রী হয়ে প্রথমবার যখন কলকাতা এলেন, ১৯৮৯ সালে, আমরা স্কুলের পিছনের গেট দিয়ে বেরিয়ে সোজা এয়ারপোর্টের রানওয়ের পাশে তাকে স্বাগত জানাতে দাঁড়িয়েছিলাম। আলাদা ডোমেস্টিক টার্মিনালের তখন কোনো অস্তিত্ব ছিল না। যারা এখনকার কলকাতা এয়ারপোর্টই শুধু দেখেছেন তাদের জন্য জানাই MS DHONI সিনেমাতে ধোনি আগরতলার প্লেন মিস করার জন্য যে কলকাতা এয়ারপোর্ট দেখিয়েছে আমি তার কথা বলছি। ১৯৯১ সালে আমাদের সেই স্কুল ভেঙেই ওই তৎকালীন আধুনিক ডোমেস্টিক টার্মিনাল তৈরি হয়। সাতটা মাঠ ও সম্পূর্ন ভাবে ছড়িয়ে থাকা ক্লাসরুমের স্কুল ছেড়ে উঠে আসতে হয়েছিল একটা দোতলা বিল্ডিং ও একফালি মাঠ সহ একটি স্কুলবাড়িতে। যা আজও আছে এয়ারপোর্ট ২নং গেটের কাছে। স্কুলবাড়িটা তিনতলা হয়েছে। আমাদের সময়কার মাধ্যমিক স্কুল আজ উচ্চমাধ্যমিক স্কুল। তিন বছর সেই স্কুলেও কাটিয়েছি। মোমবাতির প্রজ্জলিত শিখা (আমাদের স্কুলের প্রতীক) আজও শতশত ছাত্রছাত্রীকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করে চলেছে। তবু কেন জানিনা, পুরোনো স্কুলটা আমায় বড্ড বেশি টানে।
অভিশাপ আমি বিশ্বাস করি না। কিন্তু এইভাবে কেউ উচ্ছেদ হলে মনে হয় উদ্বাস্তুদের দীর্ঘশ্বাস পড়ে। কয়েকদিন আগে জমজমাট আলোকসজ্জায় ঝলমলে কলকাতা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নেমে ভলভো বাস ধরতে গিয়ে অন্ধকারাচ্ছন্ন পোড়াবাড়ির মতো সেই ডোমেস্টিক টার্মিনালটাকে পড়ে থাকতে দেখে, সত্যিই মনে হল, হ্যা, দীর্ঘশ্বাস পড়ে।
© সুব্রত চৌধুরী
Comments
Post a Comment