অশৌচ ও দই-কাতলা
১৯৪৩ সাল। দু-বছর বয়সে পিতৃহারা ছেলেটি আজ পাঁচ বছর বয়সী। দিদির বয়েস সাত। দিদির তবু যদিবা আধো আধো বাপের মুখ মনে পড়ে, ভাই তো জানেই না বাবা কি। রাস্তা দিয়ে চলেছে নিজের কাকাদের বাড়ি, ভরদুপুরে। কি একটা পুজো আছে যেন।
বাংলাদেশের ফরিদপুর থেকে ১৯৩০ সালে কলকাতা এসে চাকরিতে যোগদান করেছিলেন ভদ্রলোক। বিবাহের পর সংসার পেতেছিলেন কলকাতাতেই। নিজের দুই ভাই কেও চাকরির ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। তারা যদিও তৎক্ষণাৎ পরিবার আনেননি।
১৯৪০ সালে তার আকস্মিক মৃত্যুতে পুরো ছবিটা কেমন পাল্টে গেল। তিন ভাইয়ে মিলে যে বাড়ি কেনার জন্য মোটা টাকা বায়না দেওয়া হয়ে গিয়েছিল, তা রাতারাতি দু জনের নামে হয়ে গেল। দেশের সম্পত্তিও বিক্রিবাটা করে দু-ভাগেই ভাগ হলো। সবই অজান্তে। ২৩-২৪ বছরের একটি মহিলা, সাথে দুই সন্তান, ঠাঁই হল বাপের বাড়িতে। সেখানেও বাপ বেঁচে ছিল বলে জুটলো একটা ঘর। তিনি চোখ বুজতেই ভাই'রা না তাড়ালেও, ইলেক্ট্রিকের লাইনটাও কেটে দিলো।
মহিলা জানত সেলাইয়ের কাজ। খেলনা বানাতে পারতো। নিজের দুই সন্তানের মুখ চেয়ে ঘরেই সেলাইয়ের কাজ চালু করলো টুকটাক। তাই দিয়ে কি তিনটে পেট ভরে দুবেলা? তায় আবার সেই সময়ের কুখ্যাত মন্বন্তর। পেটের জ্বালা বড় জ্বালা। নিজের বুকে পাথর রেখে সন্তানদের অভুক্ত মুখ চেয়েই অনুমতি দিয়েছিল, কাকাদের বাড়িতে পুজোর ভোগ খেতে যাওয়ার।
ভর দুপুরের রাস্তায় দিদি ও ভাই এর পৌঁছাতে একটু দেরিই হয়ে গিয়েছিল। একটু বেশিই দেরি হয়ে গেছিল হয়তো। না হলে, নিজের ছোট কাকিমা দুটো বাচ্চাকে বলতে পারে - "ওরে, এখন এসেছে রাজনন্দন-রাজনন্দিনী। খাবার তো শেষ, ওদের দুটো উনুনের ছাই বেড়ে দে।" খাওয়া জোটেনি ওদের।
৪৩-এর মন্বন্তরে দিদিটা বাঁচেনি ছেলেটার। মা এর জান, যক্ষার মতো রোগ হলেও বোধহয় জীবিত সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়েই বেঁচে ছিলেন। লেখা-পড়া শিখিয়ে মানুষ করেছিলেন ছেলেকে। নিজে বাল্য-বিধবা, আমিষ কোনোদিন খাননি বৈধব্য অবস্থায়। ছেলেকে কিন্তু নিজের সাধ্যমত আমিষ খাওয়া শিখিয়েছিলেন ঠিকই।
সময় বদলায় না শুধু, চাকা বোধহয় পুরোই ঘোরে। কেউ কেউ কলকাতার বুকের দ্বিতল বাড়ি, দেনার দায়ে বিক্রি করে শহরের উপকণ্ঠে ছোট্ট ছোট্ট বাড়িতে আলাদা হয়ে উঠে আসে। কেউ কপর্দকহীন অবস্থা থেকে ব্যাঙ্কে চাকরি পেয়ে মামাবাড়ির আশ্রয় ছেড়ে মা কে নিয়ে উঠে আসে, প্রথমে ভাড়া বাড়িতে পরে নিজেদের বাড়ি বানিয়ে।
১৯৮৬ সাল। রবিবার। দুজন অতিথি উপস্থিত বাড়িতে। একজনের গায়ে অশৌচের বস্ত্র, অন্যজনের গালেও না কামানো দাড়ি ভর্তি। দুই কাকার দুই সন্তান। পরিচয় দিতে, বাড়ির বয়স্কা মহিলাটি ও মধ্যবয়স্কা মহিলা দুজনেই কিংকর্তব্যবিমূঢ়। কি বলবে বুঝতে পারছে না।
এমন সময় সেই ছেলেটি ফিরল বাজার থেকে। মাছের থলিতে একটা গোটা কাতলা মাছ ও খাসির মাংস। ঘরে ঢুকতেই তার মা অতিথিদের দেখিয়ে বলল, "তোর ছোট কাকিমা মারা গেছে, ওরা তাই এসেছে।" ছেলে থেকে আজ সে মধ্যবয়স্ক লোক, দুই সন্তানের বাবা।
কথাটা শুনেও না শোনার মতো করে নিজের স্ত্রীকে বলল - "খাসির মাংস টা একটু কষা কষা কোরো, আর সাথে দই-কাতলা।"
নিজের ছেলেকে খুব ভালো করেই চিনতেন তিনি। বুঝে গেছিলেন ঝড়ের পূর্বাভাস, তাই চুপ ছিলেন। বোঝেন নি অতিথিরা। বড় কাকার ছেলে উঠে এসে বললো - "বড়দা, কাকিমা মারা গেছেন। ভাই এসেছে তোমায় শ্রাদ্ধের নিমন্ত্রণ করতে ও সাহায্য চাইতে। তোমারও তো অশৌচ। তুমি মাছ মাংস কি ভাবে খাবে?"
"কেন? যে ভাবে উনুনের ছাই খেয়েছিলাম, সেই ভাবে। একটা পাঁচ বছরের ছেলে যদি কথাটা আটচল্লিশ বছরে এসেও মনে রাখতে পারে, তাহলে ভাব, কত তৃপ্তি করে খেয়েছিলাম সেদিন। কথাটা বলেছিল ছোট কাকিমা, পাশে দাঁড়িয়ে বাড়ির বাকিরাও শুনেছিল। আজ আমায় মৃত্যু সংবাদ দিতে পাঠানো হয়নি, ব্যাংকে চাকুরীরত একটি লোককে রক্তের সম্পর্ক দেখিয়ে সাহায্য চাইতে পাঠিয়েছে জীবিত কেউ। সে রক্তের সম্পর্ক আমি ছাই খেয়েই চুকিয়ে দিয়েছি। ওনার মৃত্যুতে আমার তাই অশৌচ হয় নি, হবেও না।"
নিজের স্ত্রীর দিকে ফিরে বললেন, "এ বাড়িতে যারা থাকে, তাদের যদি কিছু হয় তবেই অশৌচের কথা ভাববে জীবনে। নচেৎ নয়। হা করে তাকিয়ে না থেকে, দই-কাতলা টা বসাও।"
©সুব্রত চৌধুরী
বাংলাদেশের ফরিদপুর থেকে ১৯৩০ সালে কলকাতা এসে চাকরিতে যোগদান করেছিলেন ভদ্রলোক। বিবাহের পর সংসার পেতেছিলেন কলকাতাতেই। নিজের দুই ভাই কেও চাকরির ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। তারা যদিও তৎক্ষণাৎ পরিবার আনেননি।
১৯৪০ সালে তার আকস্মিক মৃত্যুতে পুরো ছবিটা কেমন পাল্টে গেল। তিন ভাইয়ে মিলে যে বাড়ি কেনার জন্য মোটা টাকা বায়না দেওয়া হয়ে গিয়েছিল, তা রাতারাতি দু জনের নামে হয়ে গেল। দেশের সম্পত্তিও বিক্রিবাটা করে দু-ভাগেই ভাগ হলো। সবই অজান্তে। ২৩-২৪ বছরের একটি মহিলা, সাথে দুই সন্তান, ঠাঁই হল বাপের বাড়িতে। সেখানেও বাপ বেঁচে ছিল বলে জুটলো একটা ঘর। তিনি চোখ বুজতেই ভাই'রা না তাড়ালেও, ইলেক্ট্রিকের লাইনটাও কেটে দিলো।
মহিলা জানত সেলাইয়ের কাজ। খেলনা বানাতে পারতো। নিজের দুই সন্তানের মুখ চেয়ে ঘরেই সেলাইয়ের কাজ চালু করলো টুকটাক। তাই দিয়ে কি তিনটে পেট ভরে দুবেলা? তায় আবার সেই সময়ের কুখ্যাত মন্বন্তর। পেটের জ্বালা বড় জ্বালা। নিজের বুকে পাথর রেখে সন্তানদের অভুক্ত মুখ চেয়েই অনুমতি দিয়েছিল, কাকাদের বাড়িতে পুজোর ভোগ খেতে যাওয়ার।
ভর দুপুরের রাস্তায় দিদি ও ভাই এর পৌঁছাতে একটু দেরিই হয়ে গিয়েছিল। একটু বেশিই দেরি হয়ে গেছিল হয়তো। না হলে, নিজের ছোট কাকিমা দুটো বাচ্চাকে বলতে পারে - "ওরে, এখন এসেছে রাজনন্দন-রাজনন্দিনী। খাবার তো শেষ, ওদের দুটো উনুনের ছাই বেড়ে দে।" খাওয়া জোটেনি ওদের।
৪৩-এর মন্বন্তরে দিদিটা বাঁচেনি ছেলেটার। মা এর জান, যক্ষার মতো রোগ হলেও বোধহয় জীবিত সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়েই বেঁচে ছিলেন। লেখা-পড়া শিখিয়ে মানুষ করেছিলেন ছেলেকে। নিজে বাল্য-বিধবা, আমিষ কোনোদিন খাননি বৈধব্য অবস্থায়। ছেলেকে কিন্তু নিজের সাধ্যমত আমিষ খাওয়া শিখিয়েছিলেন ঠিকই।
সময় বদলায় না শুধু, চাকা বোধহয় পুরোই ঘোরে। কেউ কেউ কলকাতার বুকের দ্বিতল বাড়ি, দেনার দায়ে বিক্রি করে শহরের উপকণ্ঠে ছোট্ট ছোট্ট বাড়িতে আলাদা হয়ে উঠে আসে। কেউ কপর্দকহীন অবস্থা থেকে ব্যাঙ্কে চাকরি পেয়ে মামাবাড়ির আশ্রয় ছেড়ে মা কে নিয়ে উঠে আসে, প্রথমে ভাড়া বাড়িতে পরে নিজেদের বাড়ি বানিয়ে।
১৯৮৬ সাল। রবিবার। দুজন অতিথি উপস্থিত বাড়িতে। একজনের গায়ে অশৌচের বস্ত্র, অন্যজনের গালেও না কামানো দাড়ি ভর্তি। দুই কাকার দুই সন্তান। পরিচয় দিতে, বাড়ির বয়স্কা মহিলাটি ও মধ্যবয়স্কা মহিলা দুজনেই কিংকর্তব্যবিমূঢ়। কি বলবে বুঝতে পারছে না।
এমন সময় সেই ছেলেটি ফিরল বাজার থেকে। মাছের থলিতে একটা গোটা কাতলা মাছ ও খাসির মাংস। ঘরে ঢুকতেই তার মা অতিথিদের দেখিয়ে বলল, "তোর ছোট কাকিমা মারা গেছে, ওরা তাই এসেছে।" ছেলে থেকে আজ সে মধ্যবয়স্ক লোক, দুই সন্তানের বাবা।
কথাটা শুনেও না শোনার মতো করে নিজের স্ত্রীকে বলল - "খাসির মাংস টা একটু কষা কষা কোরো, আর সাথে দই-কাতলা।"
নিজের ছেলেকে খুব ভালো করেই চিনতেন তিনি। বুঝে গেছিলেন ঝড়ের পূর্বাভাস, তাই চুপ ছিলেন। বোঝেন নি অতিথিরা। বড় কাকার ছেলে উঠে এসে বললো - "বড়দা, কাকিমা মারা গেছেন। ভাই এসেছে তোমায় শ্রাদ্ধের নিমন্ত্রণ করতে ও সাহায্য চাইতে। তোমারও তো অশৌচ। তুমি মাছ মাংস কি ভাবে খাবে?"
"কেন? যে ভাবে উনুনের ছাই খেয়েছিলাম, সেই ভাবে। একটা পাঁচ বছরের ছেলে যদি কথাটা আটচল্লিশ বছরে এসেও মনে রাখতে পারে, তাহলে ভাব, কত তৃপ্তি করে খেয়েছিলাম সেদিন। কথাটা বলেছিল ছোট কাকিমা, পাশে দাঁড়িয়ে বাড়ির বাকিরাও শুনেছিল। আজ আমায় মৃত্যু সংবাদ দিতে পাঠানো হয়নি, ব্যাংকে চাকুরীরত একটি লোককে রক্তের সম্পর্ক দেখিয়ে সাহায্য চাইতে পাঠিয়েছে জীবিত কেউ। সে রক্তের সম্পর্ক আমি ছাই খেয়েই চুকিয়ে দিয়েছি। ওনার মৃত্যুতে আমার তাই অশৌচ হয় নি, হবেও না।"
নিজের স্ত্রীর দিকে ফিরে বললেন, "এ বাড়িতে যারা থাকে, তাদের যদি কিছু হয় তবেই অশৌচের কথা ভাববে জীবনে। নচেৎ নয়। হা করে তাকিয়ে না থেকে, দই-কাতলা টা বসাও।"
©সুব্রত চৌধুরী
অনবদ্য👍👍👍
ReplyDelete